খুলনা নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে ২০১২ সালে নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় তিনটি নদী ও আটটি খাল পুনর্খনন করা হয়েছিল ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে। বড় করে পুনর্নির্মাণ করা হয় প্রায় সাত কিলোমিটার ড্রেন। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালের জুনে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি তাতে। ভারি বর্ষা হলেই ডুবছে খুলনা মহানগরী। এ অবস্থায় আগের তিনটি নদীসহ নয়টি খাল খনন এবং নগরীর ভেতর ১৯০ কি.মি. দীর্ঘ ড্রেন পুনর্নির্মাণ করতে নতুন প্রকল্প নিয়েছে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি)। ৮৪৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এখন পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
বারবার প্রকল্প নিলেও এবং প্রকল্পের ব্যয় বাড়লেও নগরীর জলাবদ্ধতা দূর না হওয়ায় ক্ষুব্ধ নগরবাসী। এ ব্যাপারে খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার সমকালকে বলেন, প্রকল্প পরিকল্পিত ও সময়োপযোগী না হলে এ সমস্যা থেকেই যাবে। টাকাও পানিতে ভেসে যাবে। খুলনা নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে স্থানীয়দের স্থানিক অভিজ্ঞতা, প্রকৌশলগত জ্ঞান এবং ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প করলে তা কাজে লাগবে। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। নগরবাসী যাতে ড্রেনে ময়লা না ফেলে, ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে কেউ যাতে খাল ও ড্রেন দখল করতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সচেতন করতে হবে।
খুলনা আবহাওয়া অফিস জানাচ্ছে, গত আষাঢ়ে খুলনায় ভারি বৃষ্টি হয়েছে মাত্র দুই দিন। রেকর্ড অনুযায়ী, ১২ জুলাই ৫৯ মিলিমিটার এবং ১৩ জুলাই ৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ দু’দিনই নগরীর প্রধান সড়ক থেকে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় অনেককে।
স্থানীয়রা জানান, দুই দিনেই বৃষ্টিতে নগরীর কেডিএ এভিনিউয়ের জিয়া হল থেকে ময়লাপোতা পর্যন্ত সড়কের পূর্বপাশ, খানজাহান আলী রোড, শামসুর রহমান সড়ক, স্যার ইকবাল রোড, বাইতিপাড়া, মির্জাপুর রোড, আহসান আহমেদ রোড, বাবু খান রোড ও ফারাজীপাড়ায় হাঁটুপানি জমে যায়। জলাবদ্ধতা দেখা দেয় নগরীর নিম্নাঞ্চল চাঁনমারী, লবণচরা ও মহিরবাড়ি খালপাড় এলাকায়। এ ছাড়া টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছিল নগরীর মুজগুন্নী এলাকার বাস্তুহারা কলোনি, নগরীর ফুলবাড়িগেট এলাকার খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) নিম্নাঞ্চল, তেলিগাতি ও আশপাশ এলাকায়। রোববার দুপুর পর্যন্ত এসব এলাকায় পানি ছিল।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বৃষ্টি হলেই এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক আন্দোলনের পর নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। অথচ প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও সামান্য বৃষ্টিতেই জলজট হচ্ছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
কেসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আবদুল আজিজ সমকালকে বলেন, খুলনার জলাবদ্ধতা সমস্যা কিছুটা প্রাকৃতিক। এ নগরীর বেশির ভাগ পানি বিভিন্ন ড্রেন ও খাল হয়ে ময়ূর নদীর মাধ্যমে রূপসায় গিয়ে পড়ে। সেখানে জোয়ার থাকলে পানি নিস্কাশনের সুযোগ থাকে না। তখন পানি ড্রেন উপচে রাস্তায় চলে আসে। তিনি বলেন, গত দুই দিন জোয়ারের সময় বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বেশি বৃষ্টি হওয়ায় নগরীর ড্রেন ও খালগুলো এ পানি ধারণ করতে পারেনি। ফলে সাময়িক জলজট হয়েছিল।
কেসিসির প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবির উল জব্বার জানান, নগরীর ড্রেনগুলো অনেক পুরাতন। এসব ড্রেনের ধারণক্ষমতা কম। ড্রেন ও খালগুলোর ধারণক্ষমতা বাড়ানো এবং পানি নিস্কাশনের স্লুইসগেটগুলো সংস্কার করাই নতুন প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এ প্রকল্পে ময়ূর নদীসহ আটটি খাল খনন ও পাড় বাঁধাই করা হবে। এগুলো হচ্ছে ক্ষেত্রখালী, ছড়িছড়া, হরিণটানা, নারকেলবাড়িয়া, তালতলা, লবণচরা ২ নং স্লুইসগেট খাল ও নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে ময়ূর নদী পর্যন্ত খাল। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পানি আরও দ্রুত নেমে যাবে।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক ও কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পলাশ কান্তি বালা সমকালকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন ও খাল পরিস্কার এবং পেড়িমাটি তোলার কাজ সারাবছর ধরেই চলছে। নগরীর সব ড্রেন এখন সচল। কিন্তু ভারি বৃষ্টি হলে সেই পানি নিস্কাশনের জন্য ড্রেন ও খালের আরও সংস্কার প্রয়োজন। এ লক্ষ্যেই নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সামনের বছর জলাবদ্ধতা অর্ধেক কমে যাবে। ২০২১ সালে খুলনা নগরীতে আর জলাবদ্ধতা থাকবে না।