গর্ভবতীরা ডেঙ্গুু ঝুঁকিতে

হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় লেগেই আছে। প্রতিদিনই নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরছেন তারা। তবে না ফেরার দেশেও চলে যাচ্ছেন কেউ কেউ। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এক বা একাধিক ডেঙ্গু রোগীর মৃৃত্যুর খবর আসছে। তাদের মধ্যে গর্ভবতীরাও রয়েছেন। মারাত্মক ঝুঁকি ও আতঙ্কে রয়েছেন তারা। সবচেয়ে বড় ভয় রক্তক্ষরণ। এতে বাচ্চা ও মায়ের বড় ক্ষতি হতে পারে। মৃৃৃৃত্যুও হতে পারে। এ কারণে প্রসবের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীর প্রসবের সময় একাধিক রক্তদাতা প্রস্তুত রাখতে হবে। নবজাতককে মনিটর করতে হবে। খুব বাধ্য না হলে কোনোভাবেই অপারেশন বা ব্যথার ওষুধ দিয়ে প্রসব করানো যাবে না। কোনো রকম ঝুঁকি নেয়া যাবে না। সমস্যা মনে হলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

জানা গেছে, ১০ দিন আগে জ্বর নিয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন গর্ভবতী মালিহা মাহফুজ অন্নি। পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিয়ে আসা হয় বিএসএমএমইউ হাসপাতালে। এখানে তাকে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাখা হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাজমা জাহিদ এখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত¡া। তার ছেলে ও চিকিৎসক স্বামী দুজনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। একদিকে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটোছুটি অন্যদিকে অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত তিনি। বলেন, ছেলে আর তার বাবাকে নিয়ে খুব মেন্টাল প্রেশারে আছি। তার ওপর আবার নিজেকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। সারাদিন ‘ওডোমাস’ মাখি। পুরো বাড়ি নেটিং করা। খুব জরুরি না হলে বাইরে যাই না। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। আমার গাইনোকলোজিস্ট অবশ্য বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। শুধু একটু সচেতন থাকতে হবে। দিনে-রাতে ঘুমালে মশারি ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছেন। সম্ভব হলে কটনের ফুলহাতা জামা কাপড় পরতে হবে। আর মানসিক চাপ না নিতেও বলেছেন তিনি।

কিন্তু এই পরিস্থিতিতে মানসিক শান্তি বা স্বস্তিতে থাকা কিভাবে সম্ভব? ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সালমা রউফ জানান, ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হওয়ার পর দুই তিনজন অন্তঃসত্ত¡া নারী এসেছিলেন, যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তাদের অবস্থা ভালো ছিল। এমন ক্ষেত্রে রোগীদের অনেক বেশি সাবধানে থাকতে হবে। সব সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে। আমরা বহির্বিভাগ ও গাইনি ওয়ার্ডে আসা রোগীদের আগে রক্ত পরীক্ষা করতে বলছি। যদি ডেঙ্গু ধরা পড়ে তবে তাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চা নড়াচড়া করছে কিনা। ওষুধ খাওয়া অথবা ইনজেকশন দেয়ার ব্যাপারে সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখতে হবে। অবস্থা বেশি খারাপ হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায় যদি কারো ডেঙ্গু হয় তবে তা ভয়ের বিষয়। কারণ এ সময় মায়ের শরীরের তরলের মাত্রা কমে যায়। আর এতে মায়ের পাশাপাশি পেটের সন্তানের শরীরের রক্ত চলাচল কমে যেতে পারে। বিশেষ করে শেষ তিনমাসের দিকে বা প্রসবকালীন সময়ে মায়ের ডেঙ্গু হওয়াটা বেশি ভয়ের। এ সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত মায়ের নবজাতকের মৃত্যুও হতে পারে। সব থেকে জটিল অবস্থা হবে যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্লেটলেট কমে যাওয়া প্রেগন্যান্ট কারো অপারেশন বা ডেলিভারি করাতে হয়। এমন রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দেয়াও মুশকিল। আমরা আছি মহাবিপদে বলেন তিনি। তিনি বলেন, আমাদের পরামর্শ নিতে আসা অন্তঃসত্ত¡া রোগীদের তাদের চারপাশটা পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে বলছি। পা আর হাতের অনাবৃত অংশ ঢেকে রাখতে বলছি। কারণ পায়েই মশা কামড় দেয় বেশি। মশার কয়েলের ধোঁয়া থেকে দূরে থাকার পরামর্শও দিচ্ছি। ঘর বা অফিসে অ্যারোসোল বা যে কোনো ধরনের কীটনাশক স্প্রে করার বিশ মিনিট পর তাদের সেই স্থানে যেতে বলছি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. নাজনীন আরা এ বিষয়ে বলেন, ডেঙ্গুতে এত বেশি আতঙ্কিত না হয়ে বরং সচেতন হওয়া দরকার। কারণ ছয় মাসের অন্তঃসত্ত¡া নারীর ক্ষেত্রে এই ভাইরাস জ্বরে মৃত্যুর হার খুবই কম। ১০০-তে একজন। কিন্তু পরের তিনমাসের অন্তঃসত্ত¡া নারীদের ক্ষেত্রে এটি কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে এ ধরনের ভাইরাসে মৃত্যুর হার ১০০-তে ২০ জন। আর তাই সতর্কতা ও সচেতনতা দরকার।

ডা. নাজনীন বলেন, অন্তঃসত্ত¡া নারীদের উচিত জ্বর এলেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রক্তের সিবিসি করানো। এই জ্বরে নাপা-প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। প্লেটলেট কম এলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। এ ছাড়া জ্বরের শুরুতে একবার ও চার দিন পর দুই দফায় ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে। ওয়ার্নিং কিছু সাইন আছে। যেমন প্রসাব কমে যাওয়া, দুর্বল লাগা, পেটব্যথা, অতিরিক্ত বমি শরীরের চামড়ায় বা মুখে র‌্যাশ বা মেস্তা জাতীয় লাল ছোপ হতে পারে এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। জ্বর কমে যাওয়ার সময়টা সবচেয়ে ভয়ের। এই সময়টা চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হবে।

তিনি আরো বলেন, গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুর সবচেয়ে বড় ভয় বিøডিং (রক্তক্ষরণ)। তাই এ সময় ডেলিভারিতে নরমাল বা সিজার দুই ক্ষেত্রেই বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। বিশেষ করে রোগী যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় তবে তার জন্য একাধিক রক্তদাতা প্রস্তুত রাখতে হবে। ডেলিভারির পরপরই নবজাতককে মনিটর করতে হবে (শিশু বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে)। তাছাড়া ডেলিভারির পর প্রচুর রক্তপাত হতে পারে। তাই খুব বাধ্য না হলে অন্তঃসত্ত¡া ডেঙ্গু রোগীকে কোনোভাবেই অপারেশন বা ব্যথার ওষুধ দিয়ে ডেলিভারি করানো যাবে না।

আপনি আরও পড়তে পারেন