যে ভয়ংকর ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষায় নিহত রাশিয়ার ৫ বিজ্ঞানী

রকেট বিস্ফোরণে রাশিয়ার পাঁচ পরমানু বিজ্ঞানী নিহত হওয়ার ঘটনায় তৈরি হয়েছে রহস্য। গত বৃহস্পতিবার একটি পরমাণু শক্তিচালিত ইঞ্জিনের পরীক্ষা চালাতে গিয়ে রকেট বিস্ফোরণে তারা নিহত হন। মস্কোর ৩৭৩ কিলোমিটার পূর্বে সারভ শহরে পাঁচ পরমাণু প্রকৌশলীকে কবর দেওয়া হয়। তাদের নিহত হওয়ার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কৌতুহল, আর্কটিক সাগরে কি এমন বিপদজনক পারমানবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছিল রাশিয়া?

রুশ সরকারি পরমাণু সংস্থা রোসাটমের ভাষ্য অনুযায়ী এই বিশেষজ্ঞরা চালাচ্ছিলেন। ঘটনার ব্যাপারে এর বেশি কোন তথ্য তারা দেয়নি। খবর বিবিসির।

পরীক্ষাটি চালানো হচ্ছিল আর্কটিক সাগরে পানির ওপর এক প্ল্যাটফর্মে। এটি রুশ নৌবাহিনী একটি প্রশিক্ষণ রেঞ্জ।এখানে এর আগে পরমাণু শক্তিচালিত একটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ‘বুরেভেস্টনিকের’ পরীক্ষা চালিয়েছিলতবে বৃহস্পতিবারের সেই পরীক্ষাটি কোন ধরণের অস্ত্র নিয়ে, সেটি রুশ কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্টভাবে বলছেন না।

সেভারোডভিনস্ক নামে একটি শহর আছে এই নয়োনস্কা টেস্ট রেঞ্জ থেকে ৪০ কিলোমিটার পূর্বে হোয়াইট সাগরের তীরে। এই বিস্ফোরণের পর ৪০ মিনিট ধরে সেখানে হঠাৎ করে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বেড়ে গিয়েছিল।

শহরটির কর্মকর্তারা জানান, সেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘন্টা প্রতি দুই মাইক্রোসিয়েভার্ট বেড়ে যায়। তবে তারপর আবার এটি কমে যায়। তবে এই বিকিরণের মাত্রা এতই কম যে তা থেকে কারও অসুস্থ হওয়ার আশংকা নেই। রাশিয়ার স্টেট এটমিক এনার্জি কর্পোরেশন (রোসাটাম) জানিয়েছে, ঐ দুর্ঘটনায় আরও তিনজন আহত হয়েছিল। তাদের হাসপাতালে রাখা হয়েছে। রাশিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষজ্ঞদের মতে সেখানে খুব সম্ভবত ‘নাইন-এম-সেভেন-থার্টি বুরেভেস্টেনিক’ নিয়ে পরীক্ষা চালানো হচ্ছিল।

গতবছর রুশ পার্লামেন্টে দেয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট পুতিন এই ক্ষেপণাস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন।ওই ভাষণে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছিলেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র যে কোন দূরত্বে আঘাত হানতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা – যে দুর্ঘটনায় পাঁচ প্রকৌশলীর প্রাণ গেছে সেখানে হয়তো ভিন্ন কোন সমরাস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা চালানো হচ্ছিল। এর একটি হতে পারে জাহাজ বিধ্বংসী দূর পাল্লা ক্ষেপণাস্ত্র জিরকন। এটি হাইপারসনিক, শব্দের চেয়ে আট গুণ বেশি গতিতে চলতে পারে। অথবা হতে পারে নতুন ধরণের দূর পাল্লার এক ড্রোন, পসাইডন। এটি সাগরের নীচ দিয়ে যায় এবং সাবমেরিন থেকে পরিচালনা করা যায়।

যে পাঁচজন প্রকৌশলী নিহত হয়েছেন তাদেরকে রাশিয়ার সবচেয়ে উঁচুমানের বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় বীর বলে বর্ণনা করছেন সরকারি পরমাণু সংস্থা রোসাটামের কর্মকর্তা ভ্যালেন্টিন কোসটুয়োকভ। তিনি সারভ পরমাণু কেন্দ্রের প্রধান। এখানেই স্নায়ু যুদ্ধের সময় রাশিয়ার হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করা হয়েছিল।

শুরুতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, তরল জ্বালানিচালিত একটি রকেট দুর্ঘটনায় দুজন মারা গেছে। তবে পরে রোসাটাম জানায় এই দুর্ঘটনায় রেডিও আইসোটোপ জ্বালানির সম্পর্ক আছে এবং এটি ঘটেছে সাগরের মাঝখানে নির্মিত প্লাটফর্মে।

রোসাটাম আরও বলেছিল, প্রকৌশলীরা তাদের পরীক্ষা ভালোভাবেই শেষ করেন। কিন্তু তারপরই সেখানে আগুন ধরে যায় এবং ইঞ্জিনটি বিস্ফোরিত হয়। তখন এই পাঁচজন বিস্ফোরণের ধাক্কায় উড়ে গিয়ে সাগরের পানিতে পড়েন।

বিস্ফোরণের পরপরই সেভারোডভিনস্কের প্রশাসন জানায়, ৪০ মিনিটের জন্য শহরে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বেড়ে যায়। এবং এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শহরের লোকজন ঔষধের দোকানে ভিড় করে আয়োডিন কেনার জন্য। তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা পেতে আয়োডিন সহায়তা করে। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্রে বিস্ফোরণের পরও একই ভাবে আয়োডিন কেনার জন্য লাইন দিয়েছিল সেখানকার মানুষ।

এই পরীক্ষাটি চালানোর আগে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নয়োনস্কা টেস্ট রেঞ্জের চারপাশের এলাকা জুড়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সেখানে বেসামরিক জাহাজ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে।

নরওয়ের একটি নিউজ সাইটের খবর অনুযায়ী, রাশিয়ার একটি বিশেষায়িত পারমাণবিক জাহাজ ‘সেরেব্রিয়াংকা’ গত ৯ই আগষ্ট সেখানে ছিল। জল্পনা আছে যে, সেখানে ছড়িয়ে পড়া পরমাণু বর্জ্য সংগ্রহের জন্য এটিকে পাঠানো হয়েছিল।

রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট নামে একটি গবেষণা সংস্থার মার্ক গ্যালিওটি বলেন, বুরেভেস্টনিক ক্ষেপণাস্ত্র শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে অনেক সংশয় আছে। তিনি জানান, এর আগে রাশিয়ার আরেকটি অত্যাধুনিক ক্ষেপনাস্ত্র বুলাভার অনেক পরীক্ষাও ব্যর্থ হয়েছিল। তবে জিরকন এবং পসাইডন আরও অনেক অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। পানির নীচ দিয়ে চলে যে পসাইডন ড্রোন, সেটির প্রোটোটাইপ এখনই আছে। তবে এটি এরকম মারাত্মক এবং ব্যাপক বিধ্বংসী সমরাস্ত্র যে, কেবল সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন যুদ্ধে এটির ব্যবহার অবাস্তব।

রাশিয়ার সরকারী সংবাদপত্র রসিস্কায়া গেজেটা গত মাসে ‘বুরেভেস্টনিক’কে একটি প্রতিহিংসার মারণাস্ত্র বলে উল্লেখ করেছিল। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, কোন যুদ্ধে রাশিয়ার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র শত্রু দেশে আঘাত হানার পর এই বুরেভেস্টনিক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে অবশিষ্ট সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করতে সক্ষম।

সম্প্রতি মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি আইএনএফ ভেস্তে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এখন নতুন করে মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে মনোযোগ দিচ্ছে।

মিস্টার গ্যালিওটি বলছেন, রাশিয়াও একই ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র অর্জন করতে চাইছে। কারণ তারাও চীনকে নিয়ে ভয়ে আছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন