৩ কোটি টাকার ধান লোপাট, রাঘব বোয়ালরা ধরা–ছোঁয়ার বাইরে!

অসৎ উদ্দেশ্যে প্রায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের ১২৯.২২০ মেট্রিক টন হাইব্রিড জাতের ধান বীজ খামারের রেজিস্টারের লিপিবদ্ধ না করে এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়ে ঝিনাইদহের দত্তনগর কৃষি খামার থেকে বিক্রির জন্য যশোর পাঠানোর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মহেশপুরের দত্তনগর কৃষি খামারের ৩ উপ-পরিচালক ও যশোর বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের উপ-পরিচালককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বাংলাশে কৃষি উন্নয়ণ কর্পোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃপক্ষ।

একই সাথে পুনরায় তদন্তের জন্য ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে এ সংক্রান্ত নোটিশ বিএডিসি ওয়েব সাইটে দেওয়া হয়েছে।

বরখাস্তকৃতরা হলেন- দত্তনগর ফার্মের গোকুলনগর খামারের উপ পরিচালক তপন কুমার সাহা, করিঞ্চা’ খামারের উপ পরিচালক ইন্দ্রজিৎ চন্দ্র শীল, পাথিলা কৃষি খামারের উপ পরিচালক আক্তারুজ্জামান তালুকদার এবং যশোর বীজ পক্রিয়াজাত কেন্দ্রের উপ-পরিচালক মোঃ আমিন উল্যাকেও সাময়িক বরখাস্ত করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিএডিসির সচিব আব্দুল লতিফ মোল্লা সোমবার সাক্ষরিত এক চিঠিতে এই আদেশ দেন। তবে এই বিষয়টি জানা জানির পর খামারের সাথে সংশ্লিস্টরা জানিয়েছেন এই তিন উপ পরিচালকের সাথে বিএডিসির বেশ কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত। তদন্ত করে তাদের ও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবি জানিয়েছেন তারা।

বাংলাশে কৃষি উন্নয়ণ কর্পোরেশন বিএডিসি সচিব আব্দুল লতিফ মোল্লা সাক্ষরিত ১২.০৬.০০০০.২০৩.২৭. ২৮৩.১৯.৭২১/৭২২/৭২৩ ও ৭২৪ নং স্মারকের চিঠিতে বলা হয়েছে বিধি বহির্ভূতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য গোকুল নগর, পাথিলা ও করিঞ্চা বীজ উৎপাদন খামারে ২০১৮/১৯ উৎপাদন বর্ষে কর্মসূচি বহির্ভুত অতিরিক্ত ১২৯.২২০ মেট্রিক টন এসএল-৮ এইচ হাইব্রীড জাতের ধান বীজ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র যশোরে প্রেরণ করেছেন। আপনি/আপনারা অতিরিক্ত বীজ উৎপাদনের পরিমান নিয়মানুযায়ী মজুদ ও কাল্টিভেশন রেজিষ্ট্রারে লিপিবদ্ধ করেন নি। এমন কি অতিরিক্ত কোন বীজ প্রেরণের কোন চালান বা তথ্য প্রমাণ খামারে রাখেন নি। আপনার উক্ত ধান বীজ অসৎ উদ্দেশ্যে নিজেরা আত্মসাৎ করার জন্য সংরক্ষণ ও উৎপাদন বিষয়ক প্রকৃত তথ্য গোপন করেছেন মর্মে প্রতিয়মান হয়। যেহেতু আপনাদের এহেন কার্যকলাপ বিএডিসি কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা ১৯৯০ এর ৩৯ (ক)(খ)(চ) দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অসদাচারণ, চুরি, আত্মসাত, হতবিল তছরুপ ও প্রতারণার সামিল। ফলে আপনি বা আপনাকে ১৯৯০ এর ৪৫ (১) বিধি মোতাবেক সংস্থার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপন (খামার) বিএডিসি ঢাকা দপ্তরে সংযুক্তি করা হলো। এই সময়ে সাময়িক বরখাস্তকালীন বিধি মোতাবেক খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারেন না।

এছাড়াও গত ৯ সেপ্টেম্বর আরেকটি স্মারক নং ১২.০৬.০০০০.২০৩.২৭.২৮৩.১৯-৭২৫ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে যশোর বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে সদর দপ্তর হতে প্রাপ্ত কর্মসূচীর বহিভুত অতিরিক্ত ১২৯.২২০ মেটিন (এসএল৮ এইচ) হাইব্রীড বোরো ধানবীজের মধ্যে ৭৫.০৭৫ মেট্রিকটন গোকুলনগর খামার, ৩২.১১০ মেট্রিকটন পাথিলা খামার এবং ২২.০৩৫ মেট্রিকট কঞ্চিনা খামার হতে কর্তৃপক্ষের কোন অনুমোদন না নিয়ে এবং চালান ব্যতিরেকে তিন উপ পরিচালক তপন কুমার সাহা, আক্তারুজ্জামান তালুকদার, ইন্দ্রজিত শীল এবং যশোর ব্রীপ উপ পরিচালক মো: আমিন উল্ল্যার পারস্পরিক যোগসাজগে উল্লিখিত পরিমান ধান বীজ আত্মসাতের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এমন মর্মে সরেজমিন তদন্ত করে সুষ্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন ও সুপারিশ দাখিলের জন্য ৩ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এই কমিটিতে যারা রয়েছেন তারা হলেন আহ্বায়ক বিএডিসি পরিচালক (অর্থ) মোমিনুর রশিদ আমি, সদস্য বিএডিসির ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) সার ব্যবস্থাপনা আবুল কালাম আজাদ এবং উপ পরিচালক (সংস্থাপন) রাজীব হোসেন। আগামী ১০ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের মধ্যে বিএডিসির চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিবে এই কমিটি।

১২৯ মেট্রিকটন ধান বীজের বিষয়ে ২৮ আগস্ট সরেজমিন তদন্তে আসেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (খামার) তপন কুমার আইচ এবং মহাব্যবস্থাপক (বীজ) নুরুননবী সরদার। কর্মকর্তারা দত্তনগর কৃষি খামার ও যশোর বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে সরেজমিন পরিদর্শণ করেন।

উল্লেখ্য, ২০১৮-২০১৯ উৎপাদন মৌসুমে মহেশপুর উপজেলার দত্তনগর কৃষি ফার্মের পাথিলা বীজ উৎপাদন খামার হতে ৬৯.৫০০ মেট্রিক টন এবং গোকুলনগর বীজ উৎপাদন খামার হতে ১১৭.২৬০ মেট্রিক টনসহ দুটি খামার হতে সর্বমোট ১৮৬.৭৬০ মেট্রিকটন (এসএল-৮এইচ) জাতের হাইব্রিড ধান বীজ যশোর বীজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কিন্তু অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে উক্ত বীজের লটে আরো অতিরিক্ত ১২৯.২২০ মেট্রিকটন বীজ পাওয়া যায়।

এই বীজকে এখানে রেখেছে তার হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (খামার) তপন কুমার আইচ স্বাক্ষরিত স্মারক নং ১২.২৭২.০০৫.০৩.০০.০৬৪.২০১৮-১১৪,তারিখ ২২ আগস্ট এক পত্রের মাধ্যমে যশোর বীজ গোডাউনে কিভাবে অতিরিক্ত ১২৯.২২০ মেট্রিক টন (এসএল-৮এইচ) জাতের হাইব্রীড ধানের বীজ গেলো তার তথ্য প্রেরণের জন্য যশোর বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক আমিন উল্লাহ বকুলকে চিঠি দেওয়া হয়।

দত্তনগর কৃষি ফার্মের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু শ্রমিক জানান, প্রতি মৌসুমে কোন জমিতে কত পরিমাণ বীজ উৎপাদন হবে তার একটি আগাম তালিকা করা হয়। প্রতি একর জমিতে প্রায় আড়াই থেকে ৩ টন বীজ উৎপাদন হয়। কিন্তু দত্তনগর কৃষি ফার্মের বিভিন্ন বীজ উৎপাদন ফার্মের কর্মকর্তা ও যুগ্ম পরিচালক তপন কুমার যোগসাজসে হেক্টর প্রতি হাফ টন কিংবা ১ টন কম দেখিয়ে রিপোর্ট তৈরি করেন।

যে পরিমাণ বীজ সেখান থেকে উৎপাদন হয় তার একটি অংশ তারা আলাদা করে রাখেন এবং বিএডিসির প্যাকেটে ঢুকিয়ে গোপনে বিক্রি করা হয়। তেমনি ভাবে ২০১৮-২০১৯ মৌসুমের উৎপাদিত অতিরিক্ত ১২৯ মেট্রিকটন হাইব্রীড ধানের বীজ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে যশোর বীজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে তালিকাভুক্ত বীজের সাথেই একই লটে সংরক্ষণ করা হয়। যা সময় পেলেই কর্মকর্তারা সুযোগ বুঝে বিক্রি করে দিতেন। প্রতি কেজি হাইব্রীডের মূল্য ২৫০টাকা। এই হিসাবে ১২৯ মেট্রিকটন বীজের আনুমানিক মুল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা।

সূত্র আরো জানায়, এসএল-৮ এইচ জাতের হাইব্রিড বীজ বাংলাদেশে একমাত্র মহেশপুর দত্তনগর কৃষি ফার্মেই উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের অন্য কোন প্রতিষ্ঠান এই বীজ উৎপাদন করে না। এর প্রেক্ষিতে ধারণা করা হচ্ছে দত্তনগর কৃষি ফার্ম থেকেই এই বীজ পাঠানো হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন