ইলেকশন কমিশন চালাচ্ছে সিইসি আর সচিব!

 

  • আমরা আসার পর থেকেই কমিশনে স্বেচ্ছাচারিতা: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন (সাবেক নির্বাচন কমিশনার)
  • নিয়োগ সর্বসম্মতিতে গ্রহণযোগ্য হয়নি: মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
  • নিয়োগ প্রক্রিয়া কমিশনের মধ্য দিয়ে আসেনি: বদিউল আলম মজুমদার (সুশাসনের জন্য নাগরিক)
  • নিয়োগ প্রক্রিয়া আবার নতুনভাবে করতে হবে: ড. তোফায়েল আহমেদ (স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ)
  • কমিশনে ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার হিসাব নেই: মাহবুব তালুকদার (নির্বাচন কমিশনার)

অভ্যন্তরীণ অনিয়ম নির্বাচন কমিশনে। নেই মতামতের গুরুত্ব। চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। কখনো ভোটিং মেশিন কেনায় অনিয়ম, কখনো প্রশিক্ষণের নামে লোপাটের অভিযোগ। এবার এলো কমিশনের ভেতরের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ ও দুর্নীতির বিষয়টি। সমপ্রতি নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষা হয়। এতে ৩৩৯টি শূন্যপদের বিপরীতে ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন।

কিন্তু নির্বাচিতদের চূড়ান্ত করার আগে মতামত নেয়া হয়নি অন্য চার কমিশনারের। যার ফলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে অন্য চার নির্বাচন কমিশনারের প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। কমিশনে চার কোটি আট লাখ টাকার হিসাব নেই বলেও অভিযোগ রয়েছে। কমিশনারদের মতামত না নিয়ে সিইসি আর সচিবরাই ইসি চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ নিয়ে বিশ্লেষকদের ভাষ্য, চারজন কমিশনার ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার মিলেই নির্বাচন কমিশন। এটি হলো এটি একটি যৌথ সত্তা। নির্বাচন কমিশন কোনো একক সত্তা নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চার কমিশনারই যেহেতু নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে মতামত দিয়েছেন, সেহেতু এ নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে পারে না বলেও মনে করছেন অনেকে।

এর ফলে কমিশনের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে বলেও সংশ্লিষ্টদের দাবি। বিশ্লেষকরা আরও মনে করছেন, কোনো বিষয়ে অন্য কমিশনাররা যদি না চায় বা না মানেন, তবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ একজনকে কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি। সকল ক্ষমতা কমিশনের। আর কমিশন মানে হচ্ছে পাঁচজন। নিয়োগ প্রক্রিয়া আবার নতুনভাবে করতে হবে। আর সেটা যদি করা না হয় তবে নির্বাচন প্রধানকে এর দায় নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি যৌথ সত্তা। তাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার একক কর্তাব্যক্তি নয়।

সবমিলিয়ে এ সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের চোখে নির্বাচন কমিশনে যে নিয়োগ হয়েছে তা সর্বসম্মতিতে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বড় সংখ্যক একটি নিয়োগ হয়েছে তাতে সবাই মিলে বসে অভ্যন্তরীণ যে আলোচনা হতে পারতো, তা হয়নি। কমিশনের একটা জবাবদিহিতা থাকা দরকার তাও হয়নি।

এ নিয়ে এক কমিশনারের ভাষ্য, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে, যা এতদসংক্রান্ত সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও নির্বাচন কমিশন কার্যপ্রণালী বিধিমালা সমর্থন করে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চার কমিশনারের কোনো মত না নিয়েই ৩৩৯ জন কর্মচারীর নিয়োগ চূড়ান্ত করায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিইসির সঙ্গে প্রকাশ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী চলতি সপ্তাহে সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে একটি চিঠি দিয়েছেন।

চিঠিতে তাদের অভিযোগ, চার কমিশনারকে আর্থিক বিষয়সহ অনেক বিষয়ে জানানো হয়নি। ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত। তারা শুধু সিইসি ও সচিবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। নিয়োগের বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন কেনা-সংক্রান্ত প্রকল্পের বিষয়ে অবহিত না করার অভিযোগ তুলে এই চারজন ইসি সচিবকে ইউনোট দিয়েছিলেন। পরে বিষয়টি নিয়ে কমিশন সভায় আলোচনা হয় এবং সব কার্যক্রম কমিশনারদের অবহিত করা হবে বলে সিদ্ধান্তও হয়েছিল।

গত ফেব্রুয়ারিতে ইসি সচিবালয়ের মাঠপর্যায়ের কার্যালয়ে ১২তম থেকে ২০তম গ্রেডের ১০টি পদে ৩৩৯ জনকে নিয়োগ দেয়ার বিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি সচিবালয়। তাতে মোট ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন আবেদন করেন। চলতি মাসে নিয়োগ চূড়ান্ত করে নিয়োগপত্র ছাড়া হয়। এ নিয়োগ চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে চার কমিশনারের মতামত বা অনুমোদন নেয়া হয়নি। ইসি সচিবালয়ের সচিব নথি উপস্থাপন করার পর সিইসি নূরুল হুদা তা অনুমোদন করেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে অন্য চার কমিশনারকে কিছুই জানানো হয়নি। এতে অসন্তুষ্ট হন অন্যরা। নিয়োগের পেছনে চার কোটি আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ টাকার কোনো হিসাব নেই বলেও দাবি করা হচ্ছে। গত রোববার চার কমিশনার একসঙ্গে সিইসিকে চিঠি দেন। চার কমিশনার চিঠিতে বলেছেন, ইসি সচিবালয় ও কমিশনের সব বিষয় সংবিধানসহ বিদ্যমান আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ইসির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

এ বিষয়ে তারা সিইসিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তা জানানোর অনুরোধ করেছেন। চিঠিতে আরও বলা হয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জন্য অনুমোদিত বাজেট নির্ধারিত খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় অনুমোদনের ব্যাপারে কমিশনই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে কমিশনের অনুমোদন আবশ্যক। মাঝেমধ্যে নির্বাচন প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত কোনো কোনো বিষয় উপস্থাপন করা হলেও অন্য কোনো আর্থিক বিষয়ে কমিশনকে জানানো হয় না, যা নির্বাচন কমিশন আইনের ১৬ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ৩৩৯ জনের নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে, নিয়োগপত্রও ছাড়া হয়েছে। আইনকানুন অনুসরণ করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছে। অর্থ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পিএসসির প্রতিনিধিরা মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছেন। এরপর সিইসি অনুমোদন দিয়েছে।

চিঠির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, নিয়োগ নিয়ে তারা কিছু বলেননি। কমিশনের অনেক বিষয় তারা জানতে পারেন না, অনেক বিষয়ে নথিও তাদের কাছে পাঠানো হয় না। সব বিষয় যেন তাদের অবহিত করা হয়— এ বিষয়টি তারা তুলে ধরেছেন।

এদিকে এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে, যা এতদসংক্রান্ত সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও নির্বাচন কমিশন কার্যপ্রণালী বিধিমালা সমর্থন করে না।

গতকাল সোমবার নির্বাচন কমিশনের নিজ ভবনে সাংবাদিকদের কাছে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে এসব কথা বলেন তিনি। মাহবুব তালুকদার বলেন, লিখিতভাবে আমাকে আরও জানানো হয়, কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় ৩৩৯টি শূন্যপদের বিপরীতে ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র যাচাইয়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদকে চার কোটি আট লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে।

এই অর্থ প্রধান নির্বাচন কমিশনার অনুমোদন করলেও কতজন পরীক্ষককে কীভাবে এই টাকা প্রদান করা হয়, তার কোনো হিসাব নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই। এমনকি নিয়োগ কমিটির সদস্যবৃন্দ এ বিষয়ে অবহিত নন। কমিশন সচিবালয় পরীক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানে না। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের ধরনের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে  বলেছেন, নির্বাচন কমিশনে যে নিয়োগ হয়েছে এটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারিতা। যেভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। নিয়োগ দেবে কমিশন। সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। আর নিতে হবে যৌথভাবে। কেউ এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এককভাবে নিয়োগের সিদ্ধান্তকে আমি স্বেচ্ছাচারিতাই বলবো। আমরা আসার পর থেকেই নির্বাচন কমিশনে স্বেচ্ছাচারিতা দেখছি। এভাবে চললে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে, ক্ষোভের বিস্ফোরণে বড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ  বলেছেন, নির্বাচন কমিশনে যে নিয়োগ হয়েছে তা সর্বসম্মতিতে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বড় সংখ্যক একটি নিয়োগ হয়েছে তাতে সবাই মিলে বসে অভ্যন্তরীণ যে আলোচনা হতে পারতো তা হয়নি। কমিশনের একটা জবাবদিহিতা থাকা দরকার তাও হয়নি। এর কারণে অন্য কমিশনারদের প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে হচ্ছে। প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ ধরনের নিয়োগে গ্রহণযোগ্যতার জন্য সর্বসম্মতির প্রয়োজন ছিলো।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, যেহেতু নির্বাচন কমিশনের ৩৩৯ জন কর্মচারীর নিয়োগ নিয়ে চার কমিশনার এরই মধ্যে প্রতিবাদ করেছেন, তার মানে হচ্ছে— এই নিয়োগ কমিশন সভার সিদ্ধান্তে হয়নি। নিয়োগ প্রক্রিয়া আবার নতুনভাবে করতে হবে। আর সেটা যদি করা না হয়, তবে নির্বাচন প্রধানকে এর দায় নিতে হবে। ৩৩৯ জন লোক নেবেন, এটা কি আপনার একক সিদ্ধান্তে হয়ে যায়। এতে নির্বাচন কমিশনের নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলতে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বুঝায় না। চার কমিশনার এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পাঁচজন মিলেই কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

এদিকে এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজনের) সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, যেহেতু চার কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং এর ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের মতামত নেয়া হয়নি বলেছেন, তার মানে এটা স্পষ্ট নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়টি কমিশন সভার মধ্য দিয়ে আসেনি। নির্বাচন কমিশন একটা যৌথ সত্তা। তাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। উচ্চ আদালতের রায়ে আছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার একক কর্তাব্যক্তি নয়। চার কমিশনারকে বাদ দিয়ে যেভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে, এটা গ্রহণযোগ্য না। নির্বাচন কমিশনের যেকোনো বিষয় কমিশন সভায় পাঁচ কমিশনারের মতামতের ভিত্তিতে নিতে হবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন