ব্যাপক সংক্রমণের শঙ্কা

করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমিত হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। ব্যক্তি থেকে সমাজের নানা স্তরের ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে স্বল্প পরিসরের পরীক্ষায় দেশের পনেরোটি জেলায় রোগী শনাক্ত হয়েছে।

দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা রাজধানীতে। সেখানেই সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরপরেই নারায়ণগঞ্জ ও মাদারীপুরের অবস্থান।

গত তিনদিনে দেশে রোগীর সংখ্যা প্রায় এক মাসে শনাক্ত হওয়া রোগীদের ছাপিয়ে গেছে। এখন সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৩ জনে। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। গতকাল আইইডিসিআর জানিয়েছে মৃত্যুর মিছিলে ইতোমধ্যে একজন প্রথম সারির সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যাচ্ছে করোনা এখন আর সীমিত পরসিরে নয়, ভয়াবহভাবে কমিউনিটি লেভেলে সংক্রমিত হচ্ছে। দ্রুত পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করে রোগী শনাক্ত করা প্রয়োজন।

নয়তো ইউরোপের মতো এই অঞ্চলেও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে— এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশের চিকিৎসকরা। জনসমাগম বন্ধ করতে সরকার মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে যেতে বারণ করেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, করোনা ভাইরাস দেশে কি মাত্রায় কতসংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে তা আগে জানা প্রয়োজন। এজন্য করোনার উপসর্গ আছে এমন মানুষের নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। যদি তা করা না হয় তাহলে দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন আমাদের সীমিত সম্পদ নিয়ে মোকাবিলা করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, উপসর্গ আছে এমন সবাইকে মেডিকেল টেস্টের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। পর্যাপ্ত কিট মজুদ রয়েছে। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কোনো দরকার নেই। যদিও রাজধানীর ৯টি ও ঢাকার বাইরের পাঁচটি ল্যাবে চার হাজার নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা থাকলেও সেভাবে পরিধি বাড়েনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুৃজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, আতঙ্কিত হয়ে তো কোনো লাভ নেই।

আমাদের কতগুলো ক্লাস্টার পাওয়া গেছে। আমার মনে হয় এখন এইসব অঞ্চলে টেস্টগুলো যদি বেশি বেশি করা হয় তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সরকার বোধহয় টেস্ট বাড়াতে বলে দিয়েছে। এটা হলে আমাদের জন্য ভালো হবে।

তিনি বলেন, আমাদের মনে হয় টেস্টগুলো বাড়িয়ে আগে জানা দরকার দেশে কি পরিমাণ রোগী আছে। এবং সেই অনুসারে এলাকাগুলো লকডাউন করলে পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারবে। নয়তো পরিস্থিতি ধারণার চেয়েও খারাপ হতে পারে।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. মুশতাক হোসেন বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে আমরা জাতীয় কোয়ারেন্টাইন বলি। এটা যদি খুব কড়াকড়িভাবে মেনে চলি তাহলে হয়তো করোনা রোগী বেশি বাড়বে না।

স্বাস্থ্যবিধি না মেনে আগের দিনগুলোতে যেসব ভুল করেছি সেগুলো আবার করি তাহলে কি ক্ষতি হবে তার লক্ষণগুলো ইতোমধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে।

আরেকটি কথা হলো— এখন যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদেওরসংস্পর্শে আসা ব্যক্তি থেকে রোগটা আর যেন না ছড়ায় সেটা যদি নিশ্চিত করি তাহলে রোগী শনাক্তের সংখ্যাটা হ্রাস পাবে।

তিনি বলেন, রোগটা যেহেতু মানুষের হাতের মাধ্যমে ছড়ায় সেহেতু আমরা যদি মানুষের হাতের মাধ্যমে ছড়ানোটা ঠেকাই তাহলে সমাধান আছে। আর ঘরে থাকা এটা তো আবশ্যক।

ঘরে ঘরে খোঁজ নেয়া দরকার যে, কেউ খাদ্যাভাবে আছে কি না। সেই সঙ্গে দেখতে হবে কোন ঘরে জ্বর কিংবা কাশির রোগী আছে কি না।

থাকলে তাদের তথ্যটা স্বাস্থ্য বিভাগকে জানানো। সচেতনতার মনোভাব নিয়ে কমিউনিটির লোকজন যদি এটা করে তাহলে কাজটা সহজ হবে।

আইইডিসিআরের পক্ষে তো সব ঘরে ঘরে গিয়ে তথ্য নেয়া হয়তো সম্ভব না। তাই কমিউনিটি থেকে কাজটা করলে সহজ হবে। তাহলে রোগী শনাক্ত হবে। আর রোগী শনাক্ত হলেই আপনি টেস্ট করাতে পারবেন।

অল্প জ্বর, অল্প কাশি হলেই সে যেন বাসায় থাকে। ছড়িয়ে যেন না বেড়ায়। কাজেই এভাবে যদি কমিউনিটিভিত্তিক রোগী শনাক্ত করা হয় তাহলে তাদের টেস্ট করা যাবে। মৃদু সংক্রমণ থাকলে সে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবে।

বেশি হলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। আক্রান্ত হলেও নিজেকে বাসাতে আটকে রাখতে হবে। তাহলে নিশ্চয় রোগী কমে আসবে। নয়তো দেশে অনেক কিছুই হতে পারে।

ডা. মো. মুশতাক বলেন, আমরা এভাবে বলি একটিভ কমিউনিটি সার্ভিলেন্স। কমিউনিটি কোয়ারেন্টাইনের সাথে সাথে যদি কমিউিনিটি সার্ভিলেন্স যোগ করা যায় তাহলেই মুক্তি মিলবে।

নয়তো কমিউিনিটি কোয়ারেন্টাইন করা হলেও এগুলো একটু একটু করে উঠিয়ে নিলে আবার বেড়ে যাবে। করোনার উৎসকে চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে।

তাহলে আপনি দ্রুত রোগী কমিয়ে আনতে পারবেন। নয়তো এভাবে তো বেশি দিন আটকে রাখতে পারবেন না। চিহ্নিত করে রোগীকে চিকিৎসা দিলে তার স্বজনদের কোয়ারেন্টাইন করলে রোগ থেকে মুক্তি মিলবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনা ভাইরাস আর এক স্থানে সীমাবদ্ধ নেই। এটি বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের ১৫টি জেলায় কেইস পেয়েছি।

নারায়ণগঞ্জে ক্লাস্টার হিসেবে চিহ্নিত করেছি, সেখানে বেশকিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, যাতে ওখান থেকে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে। পরবর্তীতে রয়েছে মাদারীপুরের এলাকা।

তিনি বলেন, ক্লাস্টার আমরা বলব, যেখানে একাধিক ব্যক্তি আছেন এবং এক জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছেন, সে জায়গাটাকে ক্লাস্টার হিসেবে আইডেন্টিফাই করে ইনভেস্টিগেশন করে থাকি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে করোনার বিস্তার ঘটছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিন আমাদের সবার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কোনোভাবেই কেউ যেন অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হই। একান্তই যদি জরুরি কাজে বের হতেই হয় তাহলে মুখে মাস্ক ব্যবহার না করে কেউই ঘরের বাইরে বের না হই সে ব্যাপারে আমাদের সবারই সচেতন থাকতে হবে।

দেশের সর্বশেষ অবস্থা
গতকাল দেশে নতুন করে ৩৫ জনের শরীরে করোনার উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। সেইসাথে আরও তিনজনের মৃত্যুও হয়েছে। এসময় সারা দেশে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৬৮টি।

এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ১১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে করোনা বিষয়ে আয়োজিত নিয়মিত অনলাইন প্রেসব্রিফিংয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, এ নিয়ে মারা গেলেন ১২ জন, আক্রান্ত ১২৩ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার খবর নেই। এখন দেশের ১৫ জেলায় বিস্তৃত হয়েছে করোনা ভাইরাস। এরমধ্যে আক্রান্তদের ৬৪ জন ঢাকার, নারায়ণগঞ্জের ২৩ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় যতজন আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১২ জন নারায়ণগঞ্জের। মৃত তিনজনের একজন এক সপ্তাহ আগে শনাক্ত হন। বাকি দুজন হাসপাতালে আসার পরপরই মারা গেছেন। তারা দুজন নারায়ণগঞ্জের। আক্রান্তদের ৩৫ জনের বয়স ছিলো ৪১ থেকে ৫০ বছর, তাদের মধ্যে ৩০ জনই পুরুষ।

এর বাইরে ৩০-৪০ বছর বয়সি ২১ জন আক্রান্ত হন। গত ২৪ ঘণ্টায় ৭৩৯ জনকে কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭০৯ জন হোম কোয়ারেন্টাইনে এবং ৩০ জন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন। এর বাইরে ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে নেয়া হয়েছে ২৩ জনকে।

মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে যেতে বারণ : করোনা ভাইরাস ছড়ানো ঠেকাতে এখন থেকে মুসল্লিদের ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।

ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শুধু মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরা মসজিদে নামাজ আদায় করবেন।

একই নির্দেশনায় অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে সমবেত না হয়ে নিজ নিজ বাসস্থানে উপাসনা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ এই নির্দেশ অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাখাওয়াৎ হোসেন সই করা এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ভয়ানক করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে মসজিদের ক্ষেত্রে খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা ছাড়া অন্যসব মুসল্লি নিজ নিজ বাসায় নামাজ আদায় করবেন। জুমার জামাতে অংশগ্রহণের পরিবর্তে ঘরে জোহরের নামাজ আদায় করবেন। এটা সরকারের নির্দেশ।

মসজিদে জামাত চালু রাখার প্রয়োজনে খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা মিলে পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ অনধিক পাঁচজন এবং জুমার জামাতে অনধিক ১০ জন শরিক হতে পারবেন। বাইরের মুসল্লি মসজিদে জামাতে অংশ নিতে পারবেন না।

এই নির্দেশ কেউ অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, এ সময় সারা দেশে কোথাও ওয়াজ মাহফিল, তাফসির মাহফিল, তাবলিগ তালিম বা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা যাবে না।

সবাই ব্যক্তিগতভাবে তিলাওয়াত, জিকির ও দোয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহর রহমত ও বিপদমুক্তির প্রার্থনা করবেন। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও এ সময় কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক আচারানুষ্ঠানের জন্য সমবেত হতে পারবেন না।

করোনায় দুদক পরিচালকের মৃত্যু : করোনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন পরিচালক রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে মারা গেছেন।

গতকাল সোমবার সকালে তার মৃত্যু হয় বলে হাসপাতালের সমন্বয়ক ডা. শিহাব উদ্দিন জানান। ২২তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ওই কর্মকর্তা ২০১৬ সাল থেকে দুদকে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। সর্বশেষ গত ২৪ মার্চ দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অফিস করেন করোনা ভাইরাসে মারা যাওয়া ওই পরিচালক। ওই কর্মকর্তার কাছাকাছি থেকে কাজ করেছেন এমন ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন