ভারতে ফিরল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি!

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সংঘটিত যুদ্ধে (পলাশির যুদ্ধ) পরাজিত করার মাধ্যমে সম্রাজ্য দখলে নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে আগ্রাসন বিস্তার করে কোম্পানি। তারপর শুধু তাদের নির্যাতন আর বর্বরতার ইতিহাস। যা লেখা রয়েছে এই অঞ্চলের অতীতের প্রতিটি পাতায় পাতায়।

সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই আবার ফিরে এসেছে ভারতে। যে কোম্পানির অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৮ ও ১৯ শতকে ভারতবাসীরা আন্দোলন করেছে, প্রাণ দিয়েছে সেই কোম্পানি এখন একজন ভারতীয়র কাছে।

আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটে। ওই যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। বাংলা এর পর আর ফিরে পায়নি নিজেদের সেই স্বাধীনতা বা স্বকীয়তা। বাংলা দখলের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে এই অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে ব্রিটিশ সম্রাজ্য। একের পর এক অঞ্চল জোর পূর্বক দখলে নেয় ব্রিটিশরা।

শুধু মাত্র ব্যবসায় করার অজুহাতে এই কোম্পানি গঠন করেছিলেন ব্রিটিশ রানি প্রথম এলিজাবেথ। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানি গঠনকালে তাদের পণ্য ছিল ভারত থেকে মসলা, চাসহ নানা রকম দ্রব্য আমদানি করা। দুই শতাধিক ইংরেজ ব্যবসায়ীকে পূর্ব ভারতে ডাচ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করাই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য। যার ফলশ্রুতিতে তারা গঠন করেছিল বিশাল সেনাবাহিনী। তারা যেকোনো সময় যেকোনো অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা এবং রানির কাছ থেকে যুদ্ধ করার অনুমতি পেয়েছিল। ভারতে কোম্পানির প্রধান তিনটি কেন্দ্র ছিল যথাক্রমে মাদ্রাজ, বোম্বে ও কলকাতায়।

কোম্পানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে ভারতবর্ষের অনেক গুণি ব্যক্তিকে নির্যাতন আর জেল জুলুমের শিকার হতে হয়েছিল। ১৮ শতকে বিশ্বের বস্ত্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল কোম্পানির হাতে। সাধারণ মানুষ কোম্পানির নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে আঠারোশ’ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষ জেগে উঠতে শুরু করে। ১৮৫৭ সালে কোম্পানির ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (সিপাহি বিদ্রোহ) শুরু করে। তখন ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। তবে রক্ষা হয়নি ভারতবাসীর। সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষ সরাসরি ব্রিটেনের রানির তত্ত্বাবধানে চলে আসে। নির্যাতন চলে আগের মতই। কোম্পানির একশ এবং সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের একশ মিলে ২শ’ বছর এই অঞ্চলে চলে ব্রিটিশ আগ্রাসন।

সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বর্তমান কর্ণধার একজন ভারতীয় উদ্যোক্তা। বিলু্প্তির পর কোম্পানির স্থান নাম আর নির্যাতনের বর্ণনা ছিল ইতিহাসের পাতায় পাতায়। আর কোম্পানির অবস্থান নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তবে, ২০০৩ সালের দিকে কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডাররা চা ও কফির ব্যবসার মাধ্যমে একে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। ২০০৫ সালে ভারতীয় উদ্যোক্তা সঞ্জীব মেহতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামটি কিনে নেন। তখন তিনি নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন; দামি চা, কফি ও খাবার ছিল তাঁর পণ্য। ২০১০ সালে মেহতা লন্ডনের অভিজাত মে ফেয়ার অঞ্চলে কোম্পানির প্রথম দোকান চালু করেন।

মেহতা কোম্পানির নির্যাতন আর বর্বরতা নিয়ে আরব নিউজের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কোম্পানি নিয়ে মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। কিন্তু একজন ভারতীয় এই কোম্পানি কিনে নিয়েছেন। এটা জানলে ভারতবাসীর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই হবে বলে মনে করি।

সঞ্জীব মেহতার বলেন, ‘যে কোম্পানি একসময় ভারতের মালিক ছিল, সেই কোম্পানির মালিক এখন একজন ভারতীয়।’ এটি সাম্রাজ্যকে অনেকটা পাল্টা আঘাত দেওয়ার মতো। আগের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিচালিত হতো আগ্রাসনের ভিত্তিতে, আর এখানকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চলে সহমর্মিতার ভিত্তিতে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে সোনার মোহর তৈরিরও অনুমোদন পেয়েছে নতুনভাবে পথ চলা শুরু করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

সঞ্জীব মেহতাম ১৯৬০ সালে ভারতের কানপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নাগপুর এবং মুম্বাইয়ে পড়াশোনা করেন। মেহতাব ইন্সটিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ ইন্ডিয়ার চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। ১৯৯৮ সালে তিনি ইউনিলিভার বোর্ড অব বাংলাদেশের বাণিজ্যিক পরিচালক হিসাবে যোগদান করেন। ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত হন।

২০১৩ সালের অক্টোবরে হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও এমডি হন। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালে ইউনিলিভারের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে তিনি ইউনিলিভার ফিলিপিন্সের চেয়ারম্যান হিসাবে ম্যানিলায় চলে যান এবং ২০০৮ সালে ইউনিলিভার উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্যের চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত হন।

আপনি আরও পড়তে পারেন