সাংবাদিককে চোখ বেঁধে ঘণ্টায় ঘণ্টায় পেটাতো ৫ জন

ঘণ্টায় ঘণ্টায় পেটানো হতো চট্টগ্রামে অপহৃত সাংবাদিক গোলাম সরওয়ারকে। টর্চার সেলে লোক ছিল ৫ জন। এদের মধ্যে তিনজন ঢাকার ভাষায় কথা বলতো। দুই জন কথা বলতো চট্টগ্রামের ভাষায়। তুলে নেওয়ার দিন কিলঘুষিও মেরেছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হয় ঘণ্টায় ঘণ্টায় নির্যাতন। নির্যাতনের ফাঁকে ফাঁকে শুধু একটি কথায় বলতো ‘নিউজ করবি কিনা বল’। নির্যাতনকারীরা এমন কথাও বলেছে তাকে যে, এখন সাংবাদিকদের কোনো বেইল (গুরুত্ব) নেই।

সোমবার (২ অক্টোবর) সকালে ৪ দিন নিখোঁজ থাকা সাংবাদিক সারোয়ারের মুখে উঠে এলো লোমহর্ষক এই ঘটনার বণর্না। এ সময় দুই চোখ দিয়ে তার পানি পড়ছিল।

সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ও আজকের সূর্যোদয়ের চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার, সিটি নিউজ বিডি ডট কমের নির্বাহী সম্পাদক ।

কান্না জড়িত কন্ঠে সারোয়ার বলেন, ‘বেতের লাঠি দিয়ে মারতো অপহরণকারীরা। পুরো শরীরজুরেই মারের আঘাত আছে। বাদ যায়নি পায়ের তালুও। মার সহ্য করতে না পেরে আমি বারবার মুর্ছা যেতাম। হুশ ফিরে এলে আবার মারতো তারা। বলতো, নিউজ করবি কিনা বল শালার পুত। এভাবে গালিও দিত। আমি বারবার তাদেরকে বলেছি, আমি নিউজ আর করবো না, সাংবাদিকতাও ছেড়ে দিব। কিন্তু তারা সেটি শুনতো না। শুধু মারতে থাকতো।’

সারোয়ার আরো বলেন, ‘আমি বার বার জিজ্ঞেস করেছি, কোন নিউজের জন্য তোমারা আমাকে মারছ? কিন্তু সে নিউজের নাম তারা একবারও বলেনি। আমার পা বাধা ছিল। চার দিন ধরে চোখ বন্ধ ছিল। আমাকে খেতে দিত শুধু পাউরুটি আর পানি। এ চারদিন প্রতিটি ক্ষণে মনে হয়েছিল আমি এখনিই মারা যাবো। তারাও একে অপরকে বলছিল মেরে ফেলে দিই। কিন্তু অপরজন বলছিল মেরে ফেলা স্যারের নিষেধ আছে।’

তিনি বলেন, ‘টেলিফোনে তাদের কেউ একজনকে বলতে শুনেছি, সাংবাদিকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাকে (আমাকে) তুলে এনেছি, হত্যার জন্য নয়। ও সাংবাদিক খবরদার ওকে হত্যা করা যাবে না। এমন কথা মোবাইলে বলতে শুনেছি।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিহাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার বলেন, ‘আমি বুধবার রাত ১১টায় ব্যাটারী গলির বাসা থেকে বের হয়েছি। পাঁয়ে হেটে আলমাস সিনেমার উত্তর পাশের ব্যাটারী গলির মুখ থেকেই পাঠাও এর গাড়িতে উঠি নতুন ব্রীজ যাওয়ার জন্য। কিছু দুর যাওয়ার পর ভিআইপি টাওয়ারের সামনে এলেই গাড়িটা একটু স্লো হয়। তখন বাইকের পেছনে আরেকটি লোক উঠে পড়ে। আমি বাধা দিলে ওই লোক বলে এ গাড়িতে আমি যাওয়ার কথা আপনি উঠেছেন কেন? এ কথা বলতেই আমাকে কালো একটি পলি ব্যাগের মতো জিনিস মাথায় পরিয়ে দেয়। এটি পরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলেছে এমনটি বুঝতে পারি।’

তিনি বলেন, ‘আমাকে চারদিন একই ঘরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু একটি বারের জন্যও আমার চোখ খোলা হয়নি। কানেও তুলাজাতীয় বস্তু দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। তবুও ট্রেন চলাচলের শব্দ শুনতাম।’

সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারকে রোববার সন্ধ্যায় সীতাকুণ্ডের কুমিরা থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। সন্ধ্যায় সীতাকুণ্ডের বড় কুমিরা সেতুর নিচে কে বা কারা সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারকে ফেলে রেখে যায়। স্থানীয় লোকজন এক যুবককে পড়ে থাকতে দেখে থানায় খবর দেয়। পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করে।

স্থানীয়রা জানান, উদ্ধারের সময় গোলাম সরোয়ার বলতে থাকেন, ‘ভাই, আমারে মাইরেন না। আমি আর নিউজ করবো না।’

এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার আতঙ্কিত অবস্থায় এই কথা বলছেন।

আপনি আরও পড়তে পারেন