১৯৮৬ ও একজন ফুটবল জাদুকর

১৯৮৬ ও একজন ফুটবল জাদুকর

ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ বললে ভুল হবে না মেক্সিকোর আসরকে। ১৯৮৬ সালের ফুটবল মহাযজ্ঞে আর্জেন্টাইন অধিনায়কের জাদুকরী পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়েছে গোটা বিশ্ব। বলতে গেলে একাই তিনি জিতিয়েছেন লাতিন আমেরিকার দেশটির দ্বিতীয় শিরোপা। বিশ্বকাপের ১৩তম আসরে নিজে ৫ গোল করার পাশাপাশি ম্যারাডোনা সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন আরও ৫ গোল।

৩১ মে থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত হওয়া মেক্সিকোর এই আসরটি আসলে হওয়ার কথা ছিল কলম্বিয়ায়। কিন্তু লাতিন দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তারা আয়োজকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এরপর ফিফা ১৯৭০ সালের পর আবারও ফুটবল মহাযজ্ঞের আয়োজকের দায়িত্ব দেয় মেক্সিকোকে।

সম্পর্কিত খবর

মেক্সিকো সিটির ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় শিরোপা ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা। ২৫ বছর বয়সী অধিনায়ক ম্যারাডোনার হাত ধরেই এসেছে শিরোপাটি। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয়ের পথে দুই গোলই করেছিলেন ম্যারাডোনা। যার একটি ‘হ্যান্ড অব গড’, অন্যটি ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’। এরপর বেলজিয়ামের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও ম্যারাডোনা করেন জোড়া লক্ষ্যভেদ। সেই পারফরম্যান্সের ধারায় ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ঘায়েল। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপটা তাই ম্যারাডোনা ও আর্জেন্টিনার।

অন্য চোখে: প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার সুযোগ পায় কানাডা, ডেনমার্ক ও ইরাক।

একনজরে:

আয়োজক: মেক্সিকো

মোট দল: ২৪

ভেন্যু: ১২

চ্যাম্পিয়ন: আর্জেন্টিনা

রানার্স-আপ: পশ্চিম জার্মানি

মোট ম্যাচ: ৫২

মোট গোল: ১৩২

সর্বোচ্চ গোলদাতা: গ্যারি লিনেকার (ইংল্যান্ড), ৬ গোল।

সেরা খেলোয়াড়: ডিয়েগো ম্যারাডোনা (আর্জেন্টিনা)।

সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়: এনসো সিফো (বেলজিয়াম)।

ফরম্যাট:

১৯৮২ সালের বিশ্বকাপের ফরম্যাটেই হয়েছে মেক্সিকোর আসর। ২৪ দল ছয় গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলেছে একে অন্যের বিপক্ষে। প্রত্যেক গ্রুপে থাকা চার দল থেকে সেরা দুই দল নিশ্চিত করে নকআউট রাউন্ড। তাদের সঙ্গে তৃতীয় স্থানে পয়েন্টের দিক থেকে এগিয়ে থাকা চার দল সঙ্গী হয়েছে। ছয় গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন, রানার্স-আপ মিলিয়ে ১২ ও সেরা তৃতীয় হিসেবে ৪ দল নিয়ে শুরু হয় শেষ ষোলো।

গ্রুপ পর্ব:

‘এ’ গ্রুপ থেকে তিন দল জায়গা পায় শেষ ষোলোতে। আর্জেন্টিনার ও ইতালি সঙ্গে ‘বেস্ট থ্রি’ হিসেবে যায় বুলগেরিয়া। ‘বি’ গ্রুপ থেকেও পরের রাউন্ডে যায় তিন দল- মেক্সিকো, প্যারাগুয়ে ও বেলজিয়াম। ‘সি’ গ্রুপ থেকে যায় দুই দল- সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স। ‘ডি’ গ্রুপ থেকে আসে ব্রাজিল ও স্পেন। ‘ই’ গ্রুপ থেকে তিন দল, ডেনমার্ক ও পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে তৃতীয় দল হিসেবে ‍সুযোগ পায় উরুগুয়ে। ‘এফ’ গ্রুপ থেকে শেষ ষোলোতে জায়গা পায় মরক্কো, ইংল্যান্ড ও পোল্যান্ড।

শেষ ষেলো:

১৬ দল নিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় রাউন্ড। উরুগুয়েকে ১-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। শেষ আটে আলবিলেস্তেদের সঙ্গী হয় ইংল্যান্ড, স্পেন, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি ও মেক্সিকো। ইংল্যান্ড ৩-০ গোলে প্যারাগুয়েকে, স্পেন ৫-১ গোলে ডেনমার্ককে, বেলজিয়াম ৪-৩ গোলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে, ব্রাজিল ৪-০ গোলে পোল্যান্ডকে, ফ্রান্স ২-০ গোলে ইতালিকে, পশ্চিম জার্মানি ১-০ গোলে মরোক্কোকে ও মেক্সিকো ২-০ গোলে হারায় বুলগেরিয়াকে।

কোয়ার্টার ফাইনাল: বিশ্বকাপের শুরু থেকেই নজর কেড়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে বিশ্বকাপের পুরো আলো নিজের ওপর নিয়ে নেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল করে একাই সেমিফাইনালে তোলেন আলবিলেস্তেদের। মেক্সিকো সিটির ওই ম্যাচেই ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক গোলের সঙ্গে করেছেন বিতর্কিত এক গোল। ৫১ মিনিটে প্রথমবার লক্ষ্যভেদ করেন ‘হাত দিয়ে’, বিতর্কিত এই গোলটিকে ডাকা হয় ‘হ্যান্ড অব গড’ নামে। মিনিট চারেক পর করা গোলটিতে অবশ্য ফুটে ওঠে ফুটবলের আসল সৌন্দর্য। মাঝমাঠ থেকে একক প্রচেষ্টায় ইংল্যান্ডের ছয় খেলোয়াড়কে কাটিয়ে ম্যারাডোনা করেন ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’। আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বরের জাদুতে লাতিন আমেরিকার দেশটি সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ২-১ গোলে।

কোয়ার্টার ফাইনালের বাকি তিন ম্যাচই গড়েছিল টাইব্রেকারে। ব্রাজিল-ফ্রান্স ম্যাচ নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় ১-১ গোলে শেষ হওয়ার পর পেনাল্টি শুট-আউটে ফ্রান্স ৪-৩ ব্যবধানে হারায় সেলেসাওদের। পশ্চিম জার্মানি-মেক্সিকোর খেলা গোলশূন্য ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে জার্মানরা ৪-১ গোলে হারায় আয়োজকদের। স্পেন-বেলজিয়াম ম্যাচও নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় শেষ ছিল ১-১ সমতায়, এরপর টাইব্রেকারে বেলজিয়াম ৫-৪ গোলের জয়ে নিশ্চিত করে সেমিফাইনাল।

সেমিফাইনাল:

সেমিফাইনালে আবারও ম্যারাডোনা ম্যাজিক। বাঁ পায়ের জাদুতে মেক্সিকো সিটির দর্শকদের সঙ্গে তিনি মোহিত করেন টিভি পর্দায় দেখা বিশ্বের কোটি ভক্তকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল শেষ করেছিলেন যে জায়গায়, বেলজিয়ামের বিপক্ষে সেমিফাইনাল শুরু করেন ঠিক সেখান থেকে। শেষ চারের লড়াইয়েও জোড়া লক্ষ্যভেদ করে সহজেই আলবিসেলেস্তেদের ফাইনালে তোলেন ২-০ গোলের জয়ে। ৫১ মিনিটে লক্ষ্যভেদের পর ৬৩ মিনিটে দ্বিতীয় গোলটি করেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক।

ব্রাজিলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠলেও পশ্চিম জার্মানির সামনে দাঁড়াতে পারেনি ফ্রান্স। দাপুটে জার্মানদের সামনে ফরাসিরা হার মানে ২-০ গোলে। যাতে ফাইনালের মঞ্চে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় আর্জেন্টিনা-জার্মানি।

ফাইনাল:

ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাইনাল মঞ্চায়িত হয়েছিল মেক্সিকো সিটির এস্তাদিও আজতেকায়। গোটা টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফর্ম করা আর্জেন্টিনার বিপক্ষে পারেনি পশ্চিম জার্মানি। জার্মানদের ৩-২ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জেতে লাতিন আমেরিকার দেশটি।

ম্যারাডোনা গোল না পেলেও ছিলেন উজ্জ্বল। মাত্র নবম মিনিটেই আর্জেন্টিনা এগিয়ে যায় হোসে লুইস ব্রাউনের লক্ষ্যভেদে। ওই গোলে এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যাওয়া আলবিসেলেস্তেরা ব্যবধান দ্বিগুণ করে ৫৫ মিনিটে হোর্হে ভালদানো জাল খুঁজে পেলে। জার্মানদের আশা শেষই গিয়েছিল বলে ভাবা হয়েছিল। তবে ৭৪ মিনিটে কার্ল-হেইঞ্জ রুমেনিগের পর ৮০ মিনিটে রুদি ফলারের গোলে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ায় তারা। কিন্তু ৮৩ মিনিটে হোর্হে বুরুচাগার গোলে শিরোপা উৎসব করে আর্জেন্টিনা।

আপনি আরও পড়তে পারেন