ডায়াবেটিস ও শরীরের রোগ

ডায়াবেটিস ও শরীরের রোগ

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। এ বিশেষ দিনে অর্থাৎ ১৮৯১ সালের ১৪ নভেম্বরে বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেন্টিং কানাডায় জন্মগ্রহণ করেন।

বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেন্টিং এবং চার্লস বেস্ট ১৯২১ সালে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনসুলিন আবিষ্কার করেন। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের মূল ভূমিকায় ছিলেন ফ্রেডরিক বেন্টিং। ওয়ার্ল্ড ডায়াবেটিস ডে’র উদ্দেশ্য হলো- ক্যাম্পেইন বা প্রচারের মাধ্যমে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

২০২০ সালের ওয়ার্ল্ড ডায়াবেটিস ডে’র থিম বা মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘The Nurse and Diabetes’. ডায়াবেটিস রোগীদের নার্সরা সহায়তা প্রদান করে থাকে। যেহেতু ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই নার্সদের ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। মোটকথা, ডায়াবেটিসকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তা না হলে শরীরের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি অবধারিত।

দীর্ঘমেয়াদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশের ক্ষতি করতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিডনি, হার্ট, চোখ, কান, ত্বক, স্নায়ুতন্ত্র, অস্থিসন্ধি এবং প্রজননতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত করে থাকে।

ডায়াবেটিস শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। ডায়াবেটিসের জটিলতা হিসেবে কিডনি রোগ দেখা দিতে পারে। কিন্তু নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্ক মানুষ যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের চিন্তা, স্মরণশক্তি ও স্মৃতিতে বেশি সমস্যা হতে পারে। এর সার্বিক অর্থ হলো- টাইপ-২ ডায়াবেটিস ব্রেনের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায় বা সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপের একই যোগসূত্র থাকতে পারে একটি হরমোনের সঙ্গে, যা অ্যালডোস্টেরন নামে পরিচিত। গবেষণায় এমনটি দেখা গেছে। অ্যালডোস্টেরন উচ্চরক্তচাপ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের অ্যালডোস্টেরন হরমোনের পরিমাণ বেশি তাদের দ্বিগুণ সম্ভাবনা আছে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ক্ষেত্রে। রক্তে অত্যধিক পরিমাণে কলেস্টেরল থাকলে ডায়াবেটিস রোগীদের হার্টের রোগ এবং রক্তনালির রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে যায় আর উপকারী কলেস্টেরল বা এইচডিএল-এর পরিমাণ কমে যায়। ফলে হার্টের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সিনিয়রদের মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস ও ডিমেনসিয়া রয়েছে তাদের লো ব্লাড প্রেসার থেকে সৃষ্ট মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতি তিন জনের দু’জনই মারা যায় হৃদরোগজনিত কারণে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত রক্তের সুগার রক্তনালিকে ধ্বংস করে থাকে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস রোগীর রক্তনালি ধ্বংসের কারণে ডায়াবেটিস রোগীরা স্ট্রোকের ঝুঁকির মধ্যেও থাকে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণে যৌন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ডায়াবেটিস যৌন অঙ্গগুলোর রক্তনালি এবং স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে। ফলে যৌন অনুভূতি কমে যেতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের শুকনো ভাব যৌন কার্যক্রমে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে যৌন ক্ষমতা নিঃশেষ হওয়া ডায়াবেটিসের জটিলতা হিসেবে দেখা যায়।

যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এবং পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ পায়ের ক্ষতি করতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের আলাদা যত্ন নিতে হবে। যারা প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হওয়ার কারণে ওষুধ সেবন করে থাকেন, তারা টাইপ-২ ডায়াবেটিস ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অর্থাৎ এনলার্জড প্রোস্টেট ওষুধ ডায়াবেটিস ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হওয়ার কারণে যারা ফিনাসটেরাইড গ্রুপের প্রোসকার এবং ডুটাসটেরাইড বা এভোডার্টজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে আসছেন তাদের ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডায়েট সোডা পান করলে মারাÍক ধরনের ডায়াবেটিস চক্ষু রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ডায়াবেটিস রোগী অন্ধ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে যদি যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ না করে।

এক গবেষণায় দেখা যায়, অল্প বয়সীদের মাঝে যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের স্বাভাবিকের চেয়ে সাত গুণ বেশি সম্ভাবনা রয়েছে কিডনি রোগ হওয়ার ক্ষেত্রে। হৃদরোগ অথবা স্ট্রোকের সংক্রমণের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি তরুণদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। ডায়াবেটিস যেহেতু রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় সেহেতু ডায়াবেটিস রোগীর মুখে বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। মুখের অনেক রোগ সহজে ভালো হতে চায় না। আবার মুখের রোগের চিকিৎসায় ডায়াবেটিস থাকার কারণে সব ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।

ডায়াবেটিস রোগীদের অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মুখের যত্ন নিতে হবে। মুখে সামান্য সমস্যা হলেও আপনি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। ডায়াবেটিসের ওষুধ ছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ সেবনের কারণে আপনার মুখে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে মুখস্থ ওষুধ সেবন না করে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন। শারীরিক ব্যায়াম ডায়াবেটিসজনিত স্নায়ুর ব্যথার উন্নতি ঘটিয়ে থাকে। ব্যায়াম ডায়াবেটিসজনিত স্নায়ুর ক্ষতিকে ধীর করে দেয় অথবা বাধা প্রদান করে। অতএব ডায়াবেটিস রোগকে কোনোভাবেই অবহেলা করবেন না। সব সময় আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন। সুখী জীবনযাপন করুন।

লেখক : মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ
dr.faruqu@gmail.com

২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে লেখা। তথ্যসূত্র ইন্টারনেট, মেডিসিন ডট নেট এবং হেল্থ ডে নিউজ।

আপনি আরও পড়তে পারেন