মরুভূমিতে যার ঘরে বরকত নিয়ে আসেন নবীজি

মরুভূমিতে যার ঘরে বরকত নিয়ে আসেন নবীজি

তেরো বছর হয়ে গেল নবুয়তপ্রাপ্তির। জন্মভূমি মক্কায় টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে দাঁড়াল আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর জন্য। একসময় হিজরত করেন মদিনা অভিমুখে। মক্কা থেকে যখন রওয়ানা হন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবু বকর (রা.)। আরও ছিলেন তার গোলাম আমের ইবনু ফুহায়রা (রা.) এবং মরুপথের অভিজ্ঞ আবদুল্লাহ ইবনু ওরাইকিত। চারজনের ছোট্ট কাফেলা।

জন্মভূমি মক্কাকে রাসুল (সা.) অত্যন্ত ভালোবাসতেন। যারপরনাই মহব্বত করতেন। মক্কা ছাড়তে চাচ্ছিলেন না তিনি। যে-মক্কার ধূলোয় মিশে আছে তার রঙিন শৈশব, কৈশোরের মখমল স্মৃতি- কীভাবে ত্যাগ করতে পারেন। মক্কাবাসীরাই তাকে হিজরত করতে বাধ্য করেছে। বিদায়-মুহূর্তে তার দরদমাখা কথাগুলো দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নজির হয়ে থাকবে।

 

মক্কাকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) বলে ছিলেন—
‘আল্লাহর কসম! তুমি পৃথিবীর সর্বোত্তম ভূমি। গোটা দুনিয়ার মধ্যে আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় জমিন। আমাকে যদি তোমার কাছ থেকে বের করা না হত, আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’

 

আবদুল্লাহ ইবন ওরাইকিত ছিলেন বিশ্বস্ত পথপ্রদর্শক ও মরুপথের অভিজ্ঞ। কাফেলা নিয়ে এমনসব রাস্তা দিয়ে চললেন, সাধারণত অন্য কোনো কাফেলা সেখানে পৌঁছার সুযোগ ছিল না। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত মক্কাবাসীরা বিস্ময়ে বিমূঢ়। এমন হঠাৎ নিরুদ্দেশে হতাশ হয়ে পড়ে তারা। মরুপ্রহরা ও খোঁজাখুঁজি— কিছুটা শীতল হয়ে আসে।

কুদাইদ এলাকায় তখন উম্মে মা‘বাদের তাবু ছিল। কাফেলাটি এদিক থেকে অতিক্রম করবার সময় কিছুক্ষণের জন্য সেখানেও থামে। ক্ষণিকের এ-যাত্রাবিরতিতে রচিত হয় প্রাচীন আরবিসাহিত্যের এক অমরগাঁথা। পৃথিবী খুঁজে পায় সোনার হরফে লেখা এক চমৎকার গল্প।

উম্মে মা‘বাদের আসল নাম— আতিকা বিনতে খালিদ। তার গোত্র ছিল বনি খোযা‘আ। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও অতিথিপরায়ণা ছিলেন। বয়সে বৃদ্ধা হলেও সুঠামদেহী ছিলেন এ মহিলা। তার স্বভাব ছিল, তিনি তাবুর প্রাঙ্গণে বসতেন আর চলন্ত কাফেলাদের স্বাগত জানাতেন। ওখানেই সাধ্যমতো পানাহারের ব্যবস্থা করতেন। অভ্যাগতরাও তার উদার আপ্যায়ন গ্রহণ করে— পুনরায় রওয়ানা হয়ে যেত যে যার পথে।

তার ভাইয়ের নাম ছিল খুনাইস ইবন খালেদ খোজায়ি। কাফেলা এলে তিনি তাদের আপ্যায়ন করতেন। প্রাণখুলে, উদারচিত্তে। নবী করিম (সা.)-এর কাফেলাও এদিক দিয়ে অতিক্রম করেছিল। খুনাইস বড়ই আগ্রহ ও ভালোবাসা মিশিয়ে— এ ঘটনা তার ছেলে খালেদকে শুনিয়েছেন পরবর্তীতে।

চারজন বিশিষ্ট ওই কাফেলাটি যখন উম্মে মা‘বাদের তাবুতে আসে, উম্মে মা‘বাদের কাছে গোস্ত ও খেজুর আছে কিনা— জিজ্ঞাসা করে তারা। বললেন—
-আমরা পানাহারের কিছু সামান ক্রয় করতে চাই।

সেদিনগুলোতে এখানে দুর্ভিক্ষ চলছিল। বৃদ্ধার নিকট তখন বিক্রয় করার মতো অথবা মেহমানদারি করার মতো কিছুই ছিল না। উম্মে মা‘বাদ বললেন-
‘আমার নিকট কিছু থাকলে— আপনাদের আতিথেয়তায় কোনো ত্রুটি করতাম না। ছাগলগুলোও অনেক দূরে চলে গেছে।

তাবুর পাশে রাসুল (সা.) একটি ছাগল দেখতে পান। জিজ্ঞেস করলেন,
‘উম্মে মা‘বাদ! এই ছাগলটা এখানে কীভাবে?’

উম্মে মা‘বাদ বললেন, এটি কোনো কাজের না। দুর্বল হওয়ার কারণেই পালের সঙ্গে যেতে পারেনি।

রাসুলুল্লাহ (সা.) পুনরায় জানতে চান, ‘এটি কি দুধ দিতে পারে?’

উম্মে মা‘বাদ বললেন, এটাতো অনেক দুর্বল ছাগী। দুধ দিতে অক্ষম।

প্রিয়পাঠক! রাসুল (সা.)-এর চারিত্রিক মাধুর্য দেখুন, তিনি উম্মে মা‘বাদকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘আপনি কি অনুমতি দিবেন, যাতে আমি এর দুধ দোহন করতে পারি?’ উম্মে মা‘বাদ বললেন, আমার পিতামাতা আপনার ওপর কোরবান হোক! শীর্ণ কৃশকায় এ-ছাগীর মধ্যে যদি দুধ দেখা যায়— তা হলে অবশ্যই বের করুন।

আল্লাহর রাসুল (সা.) সাথীদের ইশারা করলেন, ছাগলটা কাছে নিয়ে এসো।

আল্লাহর নাম নিলেন তিনি। ছাগলের স্তনে হাত দিয়ে বরকতের দোয়া করেন। তারপর যা ঘটল— তা এককথায় বিস্ময়কর ও অলৌকিক।

ছাগলটি তার দুইপা প্রসারিত করে দিল। চর্বন করতে করতে দুধ নামিয়ে দিল স্তনে। ঠিক দুধালো ছাগীর মতো। রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মে মা‘বাদকে বললেন, ‘বড় ধরনের একটি প্লেট নিয়ে এসো।’

তিনি একটা প্লেট নিয়ে এলেন। বড়সড় প্লেট.. যা একটি দলের পক্ষে পরিতৃপ্ত হবার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহর রাসুল (সা.) দুধ দোহন করা আরম্ভ করেন। তার বরকতময় হাতের স্পর্শ লাগতেই দুধ বেরিয়ে এল। খুব দ্রুত বেগে। প্লেট ভরে গেল একসময়। ওপরের শুভ্র ফেনা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম উম্মে মা‘বাদকে বললেন, ‘উম্মে মা‘বাদ! এস, দুধ পান কর।’

তিনি পান করলে— রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সফরসঙ্গীদের বললেন, ‘এবার তোমরা পান করো।’

সাথীরা যখন দুধপান শেষ করেন, তিনি (সা.) নিজে পান করেন। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর পুরো সিরাত পড়ে দেখুন। যেখানেই খানাপিনার বিষয় আসে দেখা যাবে, তিনি প্রথমে সাথিদেরকে পানাহার করাতেন। তারপর নিজে গ্রহণ করতেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) সাথীদের বললেন, ‘আরও পান কর দুধ। একেবারে মন ভরে।’ ফলে দ্বিতীয়বারের মতো সবাই দুধ পান করলেন।

সম্মানিত পাঠক! এটাই ছিল রাসুল (সা.)-এর অনুপম চরিত্র। তিনি অন্যদের প্রথমে দুধ পান করাচ্ছেন। সবাইকে পরিতৃপ্ত করছেন। প্লেট খালি হয়ে গেল। এখন রাসুল (সা.) আবার ওই প্লেটে দুধ দোয়াচ্ছেন। দোহন করতে করতে একপর্যায়ে প্লেট পূর্ণ হয়ে গেল। মদিনার দিকে রওয়ানা হবার আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) দুধভরা ওই প্লেট উম্মে মা‘বাদকে দিয়ে যান।

তার স্বামী, যার নাম সিরাতলেখকরা হুবাইশ ইবন খালেদ আল খোজায়ি লিখেছেন, দুপুরের সময় দুর্বল ছাগলের পাল হাঁকাতে হাঁকাতে এলেন। ঘরে দুধ দেখে অবাক বিস্ময়ে উম্মে মা‘বাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, দুধ কোত্থেকে এল? যে ছাগী পেছনে রয়ে গিয়েছিল— তা তো নেহায়েত দুর্বল ও জীর্ণ। অন্যকোনো দুধালো ছাগীও ছিল না.. . ঘরেও তো দুধ ছিল না!?

জবাবে উম্মে মা‘বাদ বললেন, আবু মা‘বাদ! কিছুক্ষণ পূর্বে এখানে এক বরকতময় মানুষ এসেছিল।

এতটুকুই বললেন উম্মে মা‘বাদ। চকিত নয়নে আবু মা‘বাদ বললেন, ঘটনা কী— খুলে বলবে তো। তার বৈশিষ্ট্য ও আকৃতি তুলে ধর আমার সামনে।
উম্মে মা‘বাদ তো ছিল নিরক্ষর ও অজ্ঞ। তিনি কী জানেন— তার ঘরে কে পদার্পণ করেছিল!? কোন মহান ব্যক্তি চরণধূলি দিয়ে গেলেন? ব্যস, তিনি যা দেখেছেন তার চিত্র এমনভাবে এঁকে দিলেন, মনে হলো— শ্রোতা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সামনেই দেখছে। স্ত্রীর নিখুঁত চিত্রায়নে আবু মা‘বাদ অন্য অন্যমনস্ক  হয়ে গেল। ডুবে গেল এক গভীর ভাবনায়। কী যেন মনে করার চেষ্টা করছে সে।

উম্মে মা‘বাদ যখন সেই অচেনা পথিকের বৈশিষ্ট্যবর্ণনা শেষ করলেন, আবু মা‘বাদ বললেন, আল্লাহর কসম! তিনি তো সেই কুরাইশি ব্যক্তি যার নবুয়তের আলোচনা মক্কা থেকে ভেসে ভেসে আসছিল। মরুর লু হাওয়ায় যার কথাগুলো শান্ত-স্নিগ্ধ অনুভূত হয়। যার শীতল পরশ আমাদের এখানেও বেশ আলোচিত। আমি তো মনে মনে খুঁজছি— সে মহামানবকে। তার সাহচর্য গ্রহণ করতে চাই— এটা আমার হৃদয়ের প্রত্যাশা। তাঁর সঙ্গ পেয়ে ধন্য হতে চাই আমি। যদি সুযোগ পাই, জীবনের দীর্ঘ-লালিত এ-স্বপ্ন অবশ্যই পূরণ করব। কী জানি, প্রিয়স্বামীর চকিত চাহনি দেখে হয়ত সেদিন উম্মে মা‘বাদের অন্তরেও জন্মেছিল সেই অচেনা মানুষকে পুনর্বার দেখার আকুতি।

সুপ্রিয়পাঠক! চলুন, এবার ফিরে যাই ইতিহাসের আরেক রঙিন-মখমল অধ্যায়ে। মদিনার সোনালি পরিবেশে। সিরাতের রূপালি পাতায়। নয়ন মেলে দেখি, আল্লাহর রাসূল সা. মদিনায় সেই মহিলার সঙ্গে কী আচরণ করছেন?

সময় পার হতে বেশি বিলম্ব হয়নি। অল্প সময়ের ব্যবধানেই উম্মে মা‘বাদের ছাগল অনেক বেড়ে গেল। রঙ-বেরঙের ছাগল। প্রাচুর্যের আনন্দে ভরে গলে তার কুড়ে ঘর। ছেলেসহ ছাগলের একটি পাল নিয়ে একসময় তিনি মদিনায় এলেন। যথাসম্ভব তিনি তা বিক্রি করার জন্যই এনেছিলেন। উম্মে মা‘বাদের ছেলে আবু বকর (রা.)-কে দেখে বললেন, আম্মাজান! এ তো সেই-ব্যক্তি, যে ওই বরকতময় লোকটার সঙ্গে ছিল।

উম্মে মা‘বাদ আবু বকর (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর বান্দা! তোমার সঙ্গে কে ছিল সেই ব্যক্তি? আবু বকর (রা.) প্রশ্ন করলেন, উম্মে মা‘বাদ! তুমি চিন না তাকে?

উম্মে মা‘বাদের উত্তর, নাহ্ তো।

আবু বকুর (রা.) বলেন, তিনি তো আল্লাহর রাসুল (সা.)। উম্মে মা‘বাদ তো প্রথম থেকেই সাক্ষাৎ-পিপাসু ছিলেন। তর সয়ল না আর। মনের সুপ্ত আকুতি ব্যক্ত করলেন তিনি। আবু বকর (রা.) তাকে নিয়ে রাসুল (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হলেন।

উম্মে মা‘বাদের তাবুতে সেই ক্ষণিকের অবস্থান, তার সরল মধুর আচার-ব্যবহার কিছুই ভুলেননি আল্লাহর রাসুল (সা.)। একেই বলে আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা। এর নামই উন্নত চরিত্র, বিশ্বজয়ী নৈতিক মাধুরতা! কল্পনায় দৃষ্টি মেলে ধরুন একটু। উম্মে মা‘বাদকে মর্যাদা ও সম্মাননায় ভূষিত করছেন তিনি।

এরচেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে যে, জগতের ইমাম.. উভয় জাহানের সর্দার.. রাসূল সা. তার মেহমানদারি করেছেন। তাকে খাবার পরিবেশ করেছেন। তাকে উপহার-উপঢৌকন দিয়ে সসম্মানে বিদায় দিলেন।

এক বর্ণনায় রয়েছে, উম্মে মা‘বাদ যখন আবু বকর (রা.)-এর সমভিব্যাহারে গেলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে বিভিন্ন ধরনের গ্রাম্য উপহারসামগ্রী ও মাখন পেশ করেন তিনি। আল্লাহর রাসুল (সা.)-ও তাকে কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য হাদিয়া-তোহফা প্রদান করেন। এ-সময় ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে তিনি মুসলমান হয়ে যান।

‘আল ওয়াফা’ শীর্ষক গ্রন্থপ্রণেতা উল্লেখ করেন, উম্মে মা‘বাদ ও তার স্বামী হিজরত করেছেন। তার ভাই খুনাইসও মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন শাহাদত বরণ করেন। এভাবেই ক্ষণিকের বরকতময় সান্নিধ্যে পুরো পরিবার ঈমানদীপ্ত হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।

ড. মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন।লেখক, গবেষক ও কর্মকর্তা, বাংলাদেশ দূতাবাস, রিয়াদ, সৌদি আরব।

আপনি আরও পড়তে পারেন