৩০০ আসনে নেতাদের চিঠি, বিএনপিতে তোলপাড়

৩০০ আসনে নেতাদের চিঠি, বিএনপিতে তোলপাড়

করোনাভাইরাস মহামারিকালে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সারা দেশে পাঠানো একটি চিঠি নিয়ে দলটির মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার জন্য যারা ফরম সংগ্রহ করেছিলেন, তাদের ওই চিঠি দেওয়া হয় দলের করোনা হেল্প সেলের কার্যক্রমে সহযোগিতা করার জন্য। কিন্তু অনেকেই একে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে তারা প্রচারেও নেমেছেন। ওই চিঠি দেখিয়ে বলছেন, আগামী দিনে তাদেরই মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সূত্র মতে, ওই ঘটনা কোথাও কোথাও দলের স্থায়ী কমিটির নেতা থেকে শুরু করে সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলা নেতা, সর্বোপরি গত নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ওই চিঠি দেওয়ায় কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। অবশ্য কেউ কেউ আবার চিঠি দেওয়ার ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখছেন। তারা বলছেন, ওই চিঠিতে বিএনপি কিছুটা হলেও চাঙ্গা হবে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নের জন্য নেতাকর্মীসহ মোট দুই হাজার ৬০০ জন ফরম কেনেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ২৪১ জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে—এমন আশঙ্কায় বেশির ভাগ আসনেই একাধিক ছায়া প্রার্থী রাখার কৌশল গ্রহণ করে বিএনপি। যদিও শেষ পর্যন্ত ওই কৌশল সফল হয়নি।

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘করোনা সেলের সহযোগিতার জন্য দলীয় প্রার্থী ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দেওয়া চিঠির সঙ্গে আগামী নির্বাচনের মনোনয়নের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা এ নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন, সেটি তাদের কল্পনাপ্রসূত।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী আসনে চূড়ান্তভাবে মনোনয়নপ্রাপ্তদের মন খারাপ করার এখানে কিছু নেই। যারা দুর্বল তারাই কেবল এ নিয়ে চিন্তা করতে পারেন।’

বিএনপির করোনা পর্যবেক্ষণ সেলের আহ্বায়ক দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘দুই হাজার ৬০০ জনের মধ্যে যারা ভালো কাজ করবেন এবং করোনার এই সময়ে মানুষের পাশে দাড়াবেন, দল তাদেরই মূল্যায়ন করবে।’

তিনি বলেন, ‘চিঠি দেওয়া খারাপ কিছু হয়নি। এমন মহামারির সময়ে মানুষের পাশে না থাকলে তারা কেমন নেতা?’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১৭ আগস্ট ৩০০ আসনে প্রার্থী ও মনোনয়নপ্রত্যাশী মিলিয়ে মোট দুই হাজার ৬০০ জনকে চিঠি দিয়ে দলের করোনা হেল্প সেলের কার্যক্রমে সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানায় দলটি। করোনায় চিকিৎসাসেবাসহ নানা সহায়তার জন্য সারা দেশে জেলাগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় মোট ৮০টিরও বেশি হেল্প সেল কার্যক্রম চালু করেছে বিএনপি। ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এবং জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে। তবে জেলা ও বিভাগীয় শীর্ষ নেতারা ওই কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন বলে জানা গেছে। কারা কতটুকু ভূমিকা পালন করেছেন, তা তদারকি করে এ বিষয়ে কেন্দ্রে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য পৃথক আরেকটি নির্দেশনা পাঠিয়েছে বিএনপি।

গত ২৪ আগস্ট দলটির মহাসচিব স্বাক্ষরিত এসংক্রান্ত চিঠি সারা দেশের সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদককে পাঠানো হয়। একই চিঠিতে বিএনপির জেলা ও মহানগর পর্যায়ের কমিটিতে ১৫ শতাংশ নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হয়েছে কি না সে বিষয়েও তদারকি করে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি।

জানা গেছে, গত নির্বাচনে দলের প্রার্থী ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের করোনা সেলে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হলেও চিঠি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে নেতারা ভেবেছেন, হয়তো মৌখিকভাবে বিষয়টি প্রার্থীদের জানানো হবে। কিন্তু এখন চিঠি দেওয়ায় বেশির ভাগ নির্বাচনী এলাকায় কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ওই চিঠি নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে বলছেন, মনোনয়ন তাকেই দেওয়া হবে। দলের বাইরেও কেউ কেউ মাঠে নেমে পড়েছেন। এমনকি বিদেশ থেকে এসে যারা ফরম কিনেছিলেন, তারাও ফোন করে কেন্দ্রের কাছে ওই চিঠি চাইছেন। ফলে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এ জন্য কেউ কেউ এ ঘটনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেও দেখছেন।

বরিশাল বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক বিএম কলেজের সাবেক ভিপি মাহবুবুল হক নান্নু বলেন, ‘চিঠি দেওয়ায় আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মনে করেছেন, ঘুমিয়ে থাকা নেতারা সক্রিয় হোক। খারাপ কি!’

দলের কেন্দ্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতা ছাড়া গত নির্বাচনের পর বেশির ভাগ মনোনয়নপ্রার্থী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন বলে বিএনপিতে আলোচনা আছে। কেউ কেউ বিদেশেও চলে গেছেন। আবার অনেকে ‘খারাপ পরিস্থিতি’ দেখে গা ঢাকা দিয়েছেন। কিন্তু ওই চিঠি পাওয়ার পর তাদের অনেকে ঘর থেকে বের হয়ে কিছুটা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। অবশ্য করোনা সেলে সম্পৃক্ত হয়ে সহায়তায় এগিয়ে আসছেন—এমন সংখ্যা অত্যন্ত কম বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, বরিশালে অনেকের কাছে তিনি ওই চিঠি দেখেছেন। কিন্তু করোনা সেলের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি।

রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু জানান, তার জেলা নাটোরের কোনো প্রার্থী করোনা সেলকে এ পর্যন্ত সহায়তা করেননি।

তিনি বলেন, ‘চিঠি পাওয়ার পর মনোনয়নপ্রার্থীরা যার যার মতো ফেসবুকে প্রচার চালাচ্ছেন আর বলছেন, বিএনপি মহাসচিব তাদের চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে ভালো-খারাপ দুটিই হয়েছে। নিষ্ক্রিয় থাকা ব্যক্তিরা কিছুটা উজ্জীবিত হয়েছেন। আবার কিছুটা বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছে।

খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘মানবিক কারণে ও একটা ভালো উদ্দেশ্যে দল চিঠি দিয়েছে। কিন্তু মনোনয়নপ্রত্যাশী কিছু লোক আত্মপ্রচারে সেটা ব্যবহার করছে। এটা খুবই দুঃখজনক। এমন কাজ করাটা তাদের ঠিক হচ্ছে না।’

নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকন জানান, তার জেলায় কোনো আগ্রহী প্রার্থী সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসেননি। কেউ যোগাযোগও করেননি।

তিনি বলেন, ‘চিঠি দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশ্য হয়তো ভালো ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাভ কী হলো ভবিষ্যৎ বলে দেবে।’

আপনি আরও পড়তে পারেন