২০ দলীয় জোটকে এড়িয়ে একলা চলার নীতিকে লক্ষ্য হিসেবে নিলেও বিএনপি এখনই তা প্রকাশ্যে বলতে রাজি নয়। তবে কৌশল গ্রহণ করে দলটি শিগগিরই সরকারবিরোধী আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করবে। ওই রূপরেখা বা ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ডাক দেবে বৃহত্তর ঐক্যের। এভাবেই দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতসহ শরিক দলগুলোকে দূরে ঠেলার কৌশল নিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, সর্বশেষ গত শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে বৃহত্তর ঐক্যের কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় ২০ দলীয় জোটের রাজনীতিও স্থান পায়। সভায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আন্দোলন-সংগ্রাম বিএনপির একক নেতৃত্বে শুরু করার উচিত বলে মত প্রকাশ করেন।
বৈঠকের সূত্র মতে, টুকু বলেছেন যে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকেই শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। তিনি আরো যুক্তি দেন যে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের কেউ বর্তমানে রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। অথচ গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিসহ উদারপন্থী প্রায় প্রতিটি দল নিজস্ব শক্তি নিয়ে মাঠে আছে। যদিও বেশির ভাগ সময় বিএনপির দিকে চেয়ে থাকে তার এই জোটটির শরিকরা।
সূত্র মতে, জামায়াত প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বৈঠকে টুকু বলেন, ২০ দলের কারণে উদারপন্থী দল হওয়া সত্ত্বেও দেশে-বিদেশে জামায়াত-বিএনপিকে ব্র্যাকেট বন্দি করা হয়। এখনো আলোচনার সময় বলা হয়, নিজামী-খালেদা। তাই এমন পরিস্থিতি থেকে এখন বের হয়ে আসা উচিত। পরগাছার কারণে বটগাছ বড় হতে পারে না। তাই পরগাছা ছেঁটে দিয়ে বিএনপিকেই আন্দোলনের জন্য মাঠে নামতে হবে। এরপর ওই আন্দোলনে যারা শরিক হবে তাদের নিয়েই বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠবে। তখন ২০ দলের কেউ এলে আসবে।
সূত্র মতে, টুকুর এ ধরনের বক্তব্য দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সমর্থন করেন। উপস্থিত জ্যেষ্ঠ আরো বেশ কয়েকজন নেতাও এতে খুশি হয়ে সম্মতি জানান। তবে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান ‘তারা দীর্ঘদিন যাবত্ বিএনপির সঙ্গে আছে’ এমন যুক্তি তুলে ধরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মত দেন। পাশাপাশি ‘বেশি দল ও লোক থাকাই তো ভালো’ এমন যুক্তি দিয়ে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, তাড়ানোর দরকার কি! স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মত দেন, নির্বাচন না করলে জামায়াতকে বিদায় করার দরকার কি!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শনিবারের বৈঠকে ২০ দলীয় জোটের ইস্যুটি তারেক রহমানের নির্দেশনায়ই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্প্রতিককালে তালেবানের উত্থানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে জামায়াত ইস্যুটি তারেক রহমান নিষ্পত্তি করতে চাইছেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা মনে করেন। তা ছাড়া ওই জোটের মধ্যে এখন গুরুত্বপূর্ণ দল ও নেতার সংখ্যাও কমে গেছে বলে বিএনপির সর্বস্তরে আলোচনা আছে। এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ বড় নেতা হলেও তিনি প্রায়ই ‘বিএনপি নেতৃত্বের সংকটে রয়েছে’ এমন সমালোচনা করায় তারেক রহমানসহ দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ক্ষুব্ধ।
অলি প্রসঙ্গে গত ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিশদ আলোচনা হয়। দলটির নেতাদের মতে, এর বাইরে শুধু কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিমকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বিএনপি। সাম্প্রতিককালে তিনি বিএনপি রুষ্ট হয়, এমন কথা বলা বাদ দিয়েছেন। ফলে মনে করা হয়, বিএনপি যে ধরনের জোটই করুক না কেন, ইবরাহিম তার সঙ্গে থাকবেন। সব মিলিয়ে ২০ দলীয় জোট অটুট রাখার কোনো তাগিদ এখন আর বিএনপিতে নেই।
জানা যায়, জামায়াতকে দূরে রাখার কৌশল হিসেবে ওই জোট অকার্যকর করে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষেই বিএনপিতে মতামত এখন বেশ জোরালো। তারেক রহমান ছাড়াও দলটির স্থায়ী কমিটি প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ বেশির ভাগ সদস্য বৃহত্তর জোট তৈরি পক্ষে। এই অংশের অনেকের সঙ্গে বাম ও উদারপন্থী দলগুলোর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও জামায়াতের কারণে বৃহত্তর ঐক্যের আলোচনা শুরু করা যায়নি বলে একাধিক বিএনপি নেতা নিশ্চিত করেছেন।
বামপন্থী বড় দল সিপিবি-বাসদ সব সময়ই বলে আসছে যে বিএনপি আন্দোলন শুরু করুক। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সবার রাস্তা সময় হলে এক হয়ে যাবে।
সূত্র জানায়, এসব কারণ বিবেচনায় নিয়েই কী কী কর্মসূচির ভিত্তিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন তথা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠবে তার কিছু দাবিনামা বা প্রস্তাবনা তৈরি করছে বিএনপি। ওই কর্মসূচি এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্রস্তাবনায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একসঙ্গে আন্দোলন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের আমূল সংস্কারের কথা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, সাত দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য নিয়ে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর ঘোষিত হয় বিএনপিসহ কয়েকটি দলের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চারদলীয় জোট গঠনে একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকার ছিল। চারদল পরে ২০ দলে পরিণত হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০ দলকে দূরে রেখে বাম ও উদারপন্থী দলগুলোকে কাছে টেনে বিএনপি এখন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চায়। ওই জোটে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলো থাকবে এটি বিএনপি ধরে নিয়েছে। অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের অন্য কেউ আসতে চাইলে বিএনপি তাতে আপত্তি করবে না। তবে আগ্রহী হলেও জামায়াতকে ওই জোটে নেওয়া হবে না।
জানতে চাইলে বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বৃহত্তর ঐক্য এবং আগামীর রাজনৈতিক কৌশল প্রণয়নে আমরা কাজ করছি। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। জোট রাখা না রাখার বিষয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, বৃহত্তর ঐক্য গঠনে কাজ চলছে। দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কতগুলো কর্মসূচির প্রশ্নে আমরা প্রায় কাছাকাছি। কারণ উদার ও প্রগতিশীল দলগুলোও দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জামায়াত এখনো ২০ দলীয় জোটে আছে। তবে ভবিষ্যত্ রাজনৈতিক মেরুকরণের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’