রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই পূর্বাচলে অর্ধশতাধিক স্থাপনা

রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই পূর্বাচলে অর্ধশতাধিক স্থাপনা

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ ঃ

 

পূর্বাচলের বিভিন্ন সেক্টরে রয়েছে পাকা ও বহুতল ভবন মিলে শত শত স্থায়ী স্থাপনা। এছাড়া অস্থায়ী বসতঘর, সুইমিংপুলসহ রেস্টুরেন্ট রয়েছে আরও শতাধিক। তবে পাকা ভবনের মধ্যে একতলাই বেশি। ডুপ্লেক্স, দোতলা, তিনতলা ভবনও আছে রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই। অভিযোগ রয়েছে, কয়েকটি প্লটের অনুমোদন পেলেও নকশা না মেনে বাড়ি করার চিত্র দেখা গেছে।
এতে প্রকল্পের মূল পরিকল্পনায় বাধা হচ্ছে বলে দাবি স্থানীয় প্লট মালিকদের। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অস্থায়ী কিংবা স্থায়ীভাবে গড়ে উঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ডেইরি ফার্ম, গোডাউন, পুরোনো ব্যাটারি পোড়ানোর কারখানা, আবাসন, রেস্তোরাঁসহ অনুমোদনহীন ভবন। রাজউক সূত্রে জানা যায়, বেশকিছু প্লটে বৈধ নকশায় বাড়ি তৈরি করেছেন কতিপয় প্লট মালিকরা। এমন সংখ্যা ২০টিরও কম। ফলে ওই ২০টির অধিক পূর্বাচলে কোনো অবকাঠামো থাকার কথা নয়।
কিন্তু সরেজমিন দেখা যায় ভিন্নচিত্র। পূর্বাচলের ১৭ নম্বর সেক্টরের ৩০৩ নম্বর সড়কের ৮ নম্বর প্লটে নকশা ছাড়াই ৩ তলা ভবন তৈরি করছেন ফজু মিয়ার ছেলে প্লট ব্যবসায়ী রিপন মিয়া। তবে রিপন মিয়ার দাবি, পাঁচ কাঠার প্লটে ছয়তলার ভবন তৈরি করছেন। নকশা পাশ না হলেও অনুমোদনের জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। একই চিত্র ১৩ নম্বর সেক্টরের ৪০৮ নম্বর রোডের ৪ নম্বর প্লটে।
সেখানে দেখা যায়, নূরজাহান’স প্যারাডাইস নামে রয়েছে তিনতলা একটি বাড়ি। সূত্রমতে, ওই বাড়ির অনুমোদন নিতে পারেননি বাড়ির মালিক। তবে মন্তব্য করতে রাজি নন নিরাপত্তাকর্মী হাবিবুর রহমান। এছাড়া ১৩ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রোডের ৬৫ নম্বর প্লটের ৩তলা বাড়ি করেছেন আবদুছ ছোবহান। তার বাড়ির অনুমোদন না থাকলেও রাজউকের সঙ্গে মামলা চলছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয়রা জানান, একই সেক্টরে দেখা যায় আরও ৩টি পাকা বাড়ি। যার কোনোটারই নেই অনুমোদন। আবার ১১নং সেক্টরের ৪০৭নং প্লটের ডুপ্লেক্স বাড়ি থাকলেও নেই কোনো অনুমোদন। একইভাবে ২নং সেক্টরে নজরুল ইসলাম হোয়াইট হাউজ নামে পাকা স্থাপনায় গড়ে তুলেছেন রেস্টুরেন্ট। একই সেক্টরের ৩০৫নং রোডের ৫নং প্লটেও ২য় তলা করা হয়েছে অনুমোদন ছাড়াই। এ প্লট বিষয়ে রাজউক ইতোমধ্যে কাজ বন্ধের নোটিশ দিয়েছে বলে জানায় রূপগঞ্জ থানা পুলিশ। পূর্বাচলের বাসিন্দা ও প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার আবুল ফজল রাজু বলেন, যার প্রভাব আছে, সে-ই পাকা ভবন করে ফেলেছেন। তবে রাজউক সেগুলো ভাঙতে গেলে তারা আদালতের আশ্রয় নেন। ভেঙে দিলে তারা কোথায় থাকবেন-এমন মানবিক বিবেচনায় আদালত উচ্ছেদে স্থগিতাদেশ দেন। এ রকম ২০ জনের বিরুদ্ধে রাজউকের মামলা চলমান বলে জেনেছি। ফলে অবৈধ ভবন নির্মাণ বন্ধ হচ্ছে না।
অন্যদিকে রাজউক থেকে অনুমোদন নিয়ে বাড়ি নির্মাণ শুরু করলেও বাস্তবে মানা হয়নি নকশা। মনগড়াভাবে তৈরি করা হয়েছে এসব বাড়ি। পূর্বাচলের ৮নং সেক্টরের ৩০৭নং রোডের ২নং প্লটটিতে দেখা যায় এমন চিত্র। নকশায় পেছনে সিঁড়ি না থাকলেও বাস্তবে করেছেন সিঁড়ি।
সামনের সিঁড়িতে ৪টি কলাম দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে ৩টি। আবার লিফটের পরিমাপ ১.৫২ মি.›১.৮৩ মি. হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে রয়েছে ১.৭ মি.›১.৫৮ মি.। এভাবে পুরো বাড়ির বিভিন্ন অংশ নির্মাণ করেছেন নকশা না মেনে। অভিযোগ রয়েছে, অনুমোদন পেয়ে এমন মনগড়া নির্মাণ করা বাড়ির সংখ্যা ৯টির অধিক। যার নির্মাণকাজ চলমান।
তবে ওই যৌথ মালিকানাধীন বাড়ির মালিকপক্ষ জাকিউল ইসলাম, কানিজ নাজনীন ও গোলাম সারোয়ার জানান, তারা নকশা মেনে বাড়ি করার জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছেন। ঠিকাদার ভুল করেছেন কি না জানা নেই। সম্প্রতি এ প্রতিবেদক পূর্বাচলের ৯টি সেক্টর ঘুরে দেখতে পান, অসংখ্য টিনশেড ঘর, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, পার্ক, বাজার, বাসভবন। এসব স্থাপনার মধ্যে কথিত সাধক লেংটার মাজার ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। অনেক বছর ধরে এসব অনুমোদনহীন স্থাপনার বিষয়ে রাজউক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানান প্লট মালিকরা। পূর্বাচলের ৮নং সেক্টর এলাকার বাসিন্দা শাহিন আলম ভুঁইয়া বলেন, পূর্বাচলের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে ব্যাপক অনিয়ম হয়। পূর্বাচলে একটি কার্যালয় থাকলেও সেখানে কর্মকর্তাদের পাওয়া যায় না। তারা ঢাকায় অফিস করেন। ফলে কোনো অভিযোগ দিলেও রাজউকের প্রধান কার্যালয়ে যেতে হয়। এতে দালালের সহযোগিতা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না প্লট মালিকদের।
এসব বিষয়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মনিরুল হক হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পূর্বাচলে দু-একটা ঘরবাড়ি কেউ বানালেও তা কোনোভাবেই রাখা হবে না। রাজউক চেয়ারম্যান মহোদয় এসব বিষয়ে কঠোরতা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। পূর্বাচল কার্যালয়ে অফিস না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজউক যেখানে আমাকে অফিস করতে বলবে, সেখানেই করব। পূর্বাচলেও কর্মকর্তারা রয়েছেন।
পূর্বাচল হাইরাইজড অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প পরিচালক আবু সাইদ খন্দকার বলেন, অবৈধ ভবনগুলো উচ্ছেদে একাধিকবার রাজউক অভিযান চালিয়ে কয়েকটি অনুমোদনহীন ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। আবারও এসব নিয়ে কাজ চলছে। শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।
রূপগঞ্জ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) হযরত আলী বলেন, রাজউক থেকে অনুমোদন পেয়েছেন এমন প্লট মালিকদের অনেকেই নকশা মেনে ভবন তৈরি করছেন না বলে রাজউক থেকে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। রাজউকের প্রকৌশলীসহ তদন্তে গিয়ে বেশ কয়েকটি ভবনের ক্ষেত্রে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তাদের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন