ময়মনসিংহে বাঙালি ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধশালী অনবদ্য শিল্পকর্ম পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত

ময়মনসিংহে বাঙালি ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধশালী অনবদ্য শিল্পকর্ম পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত

ময়মনসিংহ প্রতিনিধিঃ

আজ ১০ ডিসেম্বর শুক্রবার ময়মনসিংহ শান্তি মিত্র সমাজকল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে কমিউনিটি ট্রাস্ট ময়মনসিংহ ( ফোরাম ) ও তেইজে ব্রাদার্স এর অর্থায়নে কাঁছিঝুলি খ্রীষ্টান পাড়ার মাঠে প্রতি বছরের ন্যায় এবার ও বাঙালি ঐতিহ্য ধরে রাখতে ১৪ টি ষ্টল নিয়ে অনুষ্ঠিত হল পিঠাপুলির উৎসব। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল – আনন্দ বাজুক প্রাণে, পিঠাপুলির  সুঘ্রাণে ”

আনুমানিক পাঁচশ বছর ধরে বাঙালি ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধশালী অনবদ্য গ্রামীণ শিল্পকর্ম স্বকীয়তায় অনন্য লোকজ খাবার বাংলাদেশের পিঠা। ভারত উপমহাদেশে পিঠাকে মিষ্টান্ন হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু বর্তমানে মুখরোচক টক, মিষ্টি ও ঝাল পিঠা তৈরীর প্রচলন রয়েছে। পিঠা শব্দটি সংস্কৃত পিষ্টক শব্দ থেকে এসেছে। পিষ্ট অর্থ চূর্ণিত, মর্দিত, দলিত। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ বইয়ে লিখেছেন, পিঠা হলো চালের গুঁড়া, ডাল বাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্ন বিশেষ। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান। ধান থেকে চাল হয় এবং সেই চালের গুঁড়া পিঠা তৈরির মূল উপকরণ। এছাড়াও গম, ভুট্টা, সয়াবিন, নারকেল দিয়েও পিঠা তৈরী করা হয়।

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। প্রত্যেক ঋতুতেই পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ প্রচলন আছে। তবে একেক ঋতুর পিঠা একেক রকম। তবে শীতের সময় সারাদেশে বাহারি পিঠা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে উদযাপন করা হয়। পল্লী গ্রামের প্রতিটি কৃষকের ঘরে ঘরে আমন ধান কাটার হিড়িক পড়ে যায়। কৃষকের ঘরে ছয়মাস অপেক্ষার পর নতুন ধান আসে। তাদের  অভাব দূর হয়। তখন আত্মীয় -স্বজন, বন্ধু – বান্ধব, ঝি – জামাই,  শশুর – শাশুড়ী ও পাড়া – প্রতিবেশীকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। সাথে পিঠাপুলি ও পায়েসের আয়োজন করা হয়। পিঠা ছাড়া শীতকালের কল্পনাই করা যায় না। তবে কত ধরণের পিঠার প্রচলন আছে তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়।

পিঠাপুলির উৎসব এখন শুধু গ্রামেই নয় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় এমনকি শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে এমনকি হোটেলগুলোতেও বাহারি রকমের পিঠা উৎসবের আয়োজন হয়ে থাকে। এরই অংশ হিসেবে শান্তি মিত্র সমাজকল্যাণ সংস্থা বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার শর্তে প্রতি বছর এই পিঠা উৎসবের আয়োজন করে থাকে।

সকাল ১০ টা ৩০ মিনিটে ছিল শিশুদের খেলাধুলা মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। খেলাধুলার জন্য বড়, মাঝারি ও ছোট তিনটি দল খেলায় অংশগ্রহণের জন্য নিবাচন করা হয়।

বড় দলে মারবেল দৌড়ে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রতাপ, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আবদুল্লা ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে নাহিদ। চকলেট খেলায় প্রথম স্থান অধিকার করে অরণ্য, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রতাপ ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে হোসেন।

মাঝারি দলে ব্যাঙ লাফে প্রথম স্থান অধিকার করে রাফি, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে গ্লোরি ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে জুইৎ ত্রিপুরা। চকলেট খেলায় প্রথম স্থান অধিকার করে জুইৎ ত্রিপুরা, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আদিব ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে রোজি।

ছোট দলে দৌড়ে প্রথম স্থান অধিকার করে সালগিতাল, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে খুব্রয় ত্রিপুরা ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে অনিক। চকলেট খেলায় প্রথম স্থান অধিকার করে সালগিতাল, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে খুব্রয় ত্রিপুরা ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে জয়।

বিকাল ৩ টায় পিঠা উৎসব আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পিঠা উৎসবের শুরু হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে  উপস্থিত ছিলেন শান্তি মিত্র সমাজকল্যাণ স্ংস্থার নির্বাহী পরিচালক, পলি দ্রং, সভাপতি , অরণ্য চিরান, এইচ আর ডি ও -এর নির্বাহী পরিচালক, এস. এম. রনি, ছোট তারা সমাজকল্যাণ সংস্থার হিসাব রক্ষক, মাইকেল হাসদাক এবং প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক গ্রেনার মারাক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পলি দ্রং অনুষ্ঠানের শুরুতে পিঠা উৎসবের এই মিলনমেলায় উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং অনুষ্ঠান উপভোগের আহব্বান জানান। তিনি বলেন, একসময় পিঠা ছাড়া বিয়ে-শাদী, কুটুমবাড়ি যাওয়া ইত্যাদি সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ভাবাই যেত না। বিয়ের পরে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় গুড়-মুড়ি-চিড়ে, পান-সুপারির সঙ্গে আর যা পাঠানো হতো তা হলো বিশাল ডালাভর্তি অথবা রঙিন হাঁড়িভর্তি বাহারি রঙের বিভিন্ন গঠনের ফুল পিঠা। বিয়ে বাড়িতে আত্মীয় স্বজন, নাইওরি যারা আসতেন তারাও বড় বড় হাঁড়ি ভর্তি করে পিঠা নিয়ে আসতেন। সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী পিঠা। সব অঞ্চলের পিঠাতেই রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা। আমাদের সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই আমাদের এই ক্ষুদ্র আয়োজন।

সভাপতি – অরণ্য চিরান বলেন, আজ আমি এই প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকতে পেরে খুবই আনন্দিত। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে নতুন ফসলের আগমনে সারাদেশে চলছে নবান্নের উৎসব। আজকের শ্লোগানটি “আনন্দ বাজুক প্রাণে, পিঠাপুলির  সুঘ্রাণে  “ খুবই যুক্তিযুক্ত ও সময় উপযোগী হয়েছে। তিনি এই উৎসব আয়োজনের ভুয়সী প্রশংসা করেন। এবং কবিতার ছন্দে ছন্দে বলেন,

ভাপা পিঠা চিতই পিঠা
নক‌শি পিঠা খাই
পা‌টি সাপটা চুট‌কি পিঠা
স্বা‌দে ভরা ভাই।

গ্রেনার মারাক তার বক্তব্যে বলেন, আজ ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হল, “বৈষম্য ঘোচাও, সাম্য বাড়াও, মানবাধিকারের সুরক্ষা দাও।” তিনি বলেন, মানবাধিকার হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষের মর্যাদার সাথে এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, মানুষ হিসেবে আদায় করে নিতে হয়। আমরা যে কোন ধর্মের, বর্ণের, গোত্রের বা সংস্কৃতিরই হই না কেন সেগুলো জেনে, বুঝে ও নিয়ম মেনে একে অন্যের পাশে থেকে জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে আমরা মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকব এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হলে  সব ধরণের ভয়কে দূর করে জয় করতে পারব। আমাদের শিক্ষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বেঁচে থাকবে।

আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পিঠা উৎসবের সমাপ্তি হয়।

আপনি আরও পড়তে পারেন