ছাত্র আন্দোলনের নেতা থেকে চিলির সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট

মান সম্মত শিক্ষার দাবিতে ১০ বছর আগে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির ছাত্রনেতা গ্যাব্রিয়েল বরিক। রোববার দেশটিতে অনুষ্ঠিত ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ৩৫ বছর বয়সের এই বামপন্থি নেতা। দেশটির ইতিহাসে তরুণ ছাত্রনেতা থেকে সবচেয়ে কনিষ্ঠ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তিনি।

নির্বাচনে দেশটির কট্টর ডানপন্থী নেতা জোসে অ্যান্তনিও কাস্তেকে হারিয়ে চিলির ‌‘নব্য উদারবাদী’ অর্থনৈতিক মডেলের কবর রচিত হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আইনের এই সাবেক ছাত্র।

জয় পাওয়ার পর দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরাকে রোববার রাতে টেলিফোন করে বরিক বলেন, ‌‘আপনি আমাকে ভোট দেন আর না দেন, আমি সব চিলিয়ানের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছি। এই অসাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে যাচ্ছি।’

ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, চিলির বাজার-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক মডেল নিয়ে জনগণের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ আছে। দেশটির এই অর্থনৈতিক মডেলের মাধ্যমে গত কয়েক দশকের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার মনে করে। কিন্তু দেশের অনেক সাধারণ মানুষ এবং সরকারের সমালোচকরা বলছেন, বাজার-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক মডেলের মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে।

নির্বাচনের আগে গ্যাব্রিয়েল বরিক জনগণের এমন সমালোচনার সঙ্গে একমত পোষণ করে বিতর্কিত এই মডেলের ইতি টানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আগামী মার্চে চিলির ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন তিনি।

সামাজিক বৈষম্য নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ থেকে সামাজিক অভ্যুত্থান দেখা দেয় ২০১৯ সালে। এর ফলে প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটে এবং দেশটির স্বৈরতান্ত্রিক আমলের সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়।

নির্বাচনের আগে বামপন্থি গোষ্ঠীর মনোনয়ন পাওয়ার পর বরিক বলেছিলেন, ‘চিলি যদি নব্যউদারবাদের দোলনা হয়ে থাকে, তাহলে এটি তার কবরও হবে। তরুণরা দেশ বদলে দিতে যাচ্ছে, ভয় পাবেন না।’

চীনের দক্ষিণাঞ্চলের পুন্তা অ্যারিনাস জনগোষ্ঠীর সদস্য বরিস। এক দশক আগে স্যান্টিয়াগোতে ইউনিভার্সিটি অব চিলির ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। উন্নত মান সম্মত এবং সস্তা শিক্ষার দাবিতে ২০১১ সালে দেশজুড়ে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।

২০১৪ সালে তার বয়স যখন ২০-এর কোঠায় তখনই তিনি আইনপ্রণেতা হিসেবে দেশটির সংসদের নিম্ন-কক্ষে যোগ নেন। দেশটির বিশাল এবং সবচেয়ে কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত মাগালানেস অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি।

মাথায় পাতলা কালো চুল এবং মুখে হালকা দাড়ির গ্যাব্রিয়েল বরিক ছাত্র আন্দোলনের সময়ের নেতার তুলনায় এখন অনেক পরিণত। চিলির রাজনীতিতে বামপন্থি হিসেবে পরিচিত হলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর মনোনয়ন পেতে তাকে কালো-ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতার মতো লড়তে হয়েছে।

দেশটির নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ৩৫ হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হয়। সেই সময় স্যান্টিয়াগো অঞ্চলের জনপ্রিয় মেয়র ডেনিয়েল জাদুকে হারিয়ে দেশটির বামপন্থি জোটের নেতৃত্ব পান তিনি।

তারপর থেকে বাম জোটের অনেক কট্টর বামপন্থির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় বরিকের। এমনকি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকারও বরিকের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। দেশে তরুণ সমর্থকরা বরিকের মনোনয়নে ব্যাপক উচ্ছ্বসিত হলেও অনেকে অনলাইনে তাকে নিয়ে হাস্যরস করেন।

তবে চিলিয়ান-আমেরিকান অভিনেতা পেদ্রো প্যাস্কেল থেকে শুরু করে মেক্সিকোর অভিনেতা গায়েল গার্সিয়া বার্নালের মতো অনেক হাই-প্রোফাইল সমর্থক চিলির এই নেতার প্রতি সমর্থন জানান।

চিলির দুই মেয়াদের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাচেলেট বর্তমানে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও বরিকের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘সাবেক এই ছাত্র নেতাই দেশকে সবার জন্য উন্নয়নের, ব্যাপক স্বাধীনতার, সমতার এবং মানবাধিকারের পথে নেবেন।’

কত শতাংশ ভোট পেলেন?

রোববার ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন বরিকের প্রতিদ্বন্দ্বী কাস্তে। তার পরাজয় স্বীকারের সময় প্রায় অর্ধেক ভোট গণনা সম্পন্ন হয়েছিল। গণনা শেষে দেখা যায়, সাবেক ছাত্রনেতা বরিক ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কাস্তে পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ ভোট।

গত কয়েক দশকের মধ্যে চিলির এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি মেরুকরণ হয়েছে। সরকারবিরোধী ব্যাপক গণবিক্ষোভের পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রূপকল্প নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন উভয় প্রার্থী।

শুধু তাই নয়, দেশটির সরকারে কখনও প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি এমন রাজনৈতিক দল থেকে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।

 

 

 

 

আপনি আরও পড়তে পারেন