ঈদে রূপগঞ্জে জামদানি পল্লীতে কাড়িগরদের ব্যস্ততা

ঈদে রূপগঞ্জে জামদানি পল্লীতে কাড়িগরদের ব্যস্ততা

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ ঃ ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে, জামদানি পল্লীতে কারিগরদের ব্যস্ততা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত কয়েক বছর বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে সকল ব্যবসার পাশপাশি জামদানি পল্লীতেও বেধনার নীল ছোপ দানা বেধেছিল। এবার করোনার দাপট তেমন একটা নেই বললেই চলে। বছরের শুরু থেকেই নতুন করে শুরু করেছিলেন জামদানি কারিগররা। ঈদে একটু চাহিদা বেশি। কারিগরদের এখন দম ফেলার সময় নেই। নাওয়া খাওয়া ভুলে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। ৩ বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ারও চেষ্টা রয়েছে বলে জানান ওই পল্লীর কাগিরসহ ব্যবসায়ীরা।

“ সাজ্জাদ হোসেন রানা মিয়া। জামদানি কাড়িগির। তিনি বলেন, জামদানির চাহিদা সারা বছরজুরেই থাকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত পাকিস্তানসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই জামদানির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঈদে নারীদের শাড়ি না হলে চলেই না। আর তা যদি হয় জামদানি তাহলেতো কথাই নেই।” কথায় বলে শাড়িতেই নারীকে মানাই ভাল। আর জামদানি শাড়িতো প্রতিটি নারীরই কাঙ্খিত। তাই ঈদকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়া জামদানি পল্লীতে জামদানি তাঁতিদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে। বিশ্ব দরবারে স্বতন্ত্র মহিমায় সমুজ্জল অভিজাত তাঁতবস্ত্র এ জামদানি। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে এ দেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। বিশ্ব বিশ্রুত অনন্য মসলিন শাড়ির সংস্করন অধুনা জামদানি শাড়ি। নারীর সৌন্দর্যসুধাকে বিমোহিত করে তুলতে জামদানির অপরিহার্যতা বিশেষ স্মরণীয়।

উপজেলার খামার পাড়া এলাকার গৃহিনী মনি ইসলাম। তিনি বলেন, ঈদের পোশাকতো অনেকই পাওয়া যায়। তবু ঈদে একটা জামদানি শাড়ি না হলে চলেই না। আর বাঙ্গালী নারীর সৌন্দর্য তো শাড়িতেই। তাই প্রতি ঈদে একটা জামদানি শাড়ি চাই-ই। শখ বুঝি এমনই। নতুবা আজ থেকে ২০০বছর আগে জেমস টেলর কেন রাজধানী ছেড়ে ছুটে আসবেন প্রাচীন নগরী রূপগঞ্জে। হাতির পিঠে চড়ে বৈশাখের উত্তপ্ত মধ্যা‎‎হ সূর্যকে মাথায় করে জেমস টেলরকে কোন মায়াবী টেনে এনেছিল রূপগঞ্জে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় সাদা কাপড়ের ওপর ফুলের ডিজাইন করা ৫০ হাজার টাকার মূল্যের জামদানি দিলি¬, লক্ষেèৗ, নেপাল, মুর্শিদাবাদ এলাকার নবাব ও বাদশাহরা ব্যবহার করতেন। কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি মিউজিয়ামে রক্ষিত মোঘল স্টাইলের আংরাখায় সূক্ষ¥ জামদানি জমিনে ২২ ক্যারট সোনার জরি ও সিকুইনের কাজ। আনুমানিক ১৮৭৫-১৯০০ সালে তৈরি।

ফাহিম জামদানি হাউজের মালিক ফাহিম মিয়া বলেন, জামদানি এমনভাবে তৈরি হয় যাতে শীত-গ্রীস্ম সবসময়ই পড়া যায়। তাই সারা বছরই বেচাকিনি হয় ভালই। আমরা পাইকারী খুরচা উভয়ই বিক্রি করি। তবে বিভিন্ন উৎসবে জামদানির চাহিদা আরো বেড়ে যায়। বছরজুড়েই চাহিদা থাকলেও ঈদকে সামনে রেখে জামদানি পল্লীতে চলছে কর্মব্যস্ততা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে জামদানি শিল্পীরা এখন কাপড় বুনে যাচ্ছে। এবারের ঈদে তাদের চাহিদা অনেক। এবারের ঈদে  প্রায় ৩৫ কোটি টাকার জামদানি দেশের বিভিন্ন বিপনী বিতান ও বিদেশ যাবে বলে জামদানি তাঁতিরা জানান। ফুলতেরছি, ছিটার তেরছি, ছিটার জাল, সুই জাল, হাটু ভাঙ্গা, তেরছি, ডালম তেরছি, পার্টিরজাল, পান তেরছি, গোলাপ ফুল,  জুই ফুল, পোনা ফুল, সাপলা ফুল, গুটি ফুল, মদন পাইরসহ প্রায় শতাধীক নামের জামদানি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছিটার জাল, সুই জাল ও পার্টিও জাল জামদানির মূল্যে সব চেয়ে বেশি। এসব জামদানি শাড়ির দাম পড়ে ৩০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর শাড়ি বুনতে সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে ৬ মাস পর্যন্ত। বাদশাই আমলে পরতেন রাজা-বাদশাহরা কিংবা জমিদার পরিবারের নারীরা। আর এখন পরেন ধনী ও অভিজাত রমনীরা। জামদানির গরীব গরবিনী এ রমনীরা অনেকেই জানেন না তাদের পরিধেয় সেই শাড়িটির ভাঁজে-ভাঁজে রয়েছে কত দুঃখ, বেদনা আর বঞ্চনার ইতিহাস। ইংরেজ আমলে আঙ্গুল কেটে দেয়া থেকে শুরু হাল আমলে লুন্ঠনের পরও ঢাকাই এ জামদানি শিল্প বহু কষ্টে টিকে আছে। এক একটা শাড়ির পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক একজন তাঁতীর জীবন্ত ইতিহাস।
জামদানি শাড়ি বিক্রিকে ঘিরে শীতলক্ষ্যার পাশে ডেমরায় ও নোয়াপাড়া জামদানি পল্লীতে গড়ে ওঠেছে জামদানির আড়ৎ। এ আড়ৎ প্রতি বৃহস্পতিবার প্রথম এবং শেষ রাতে জামদানির হাট বসে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসেন জামদানি শাড়ি কিনতে। প্রায় দুই শতাধীক পাইকার বিভিন্ন প্রকার জামদানি ক্রয় করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করে আসছে। দুটি হাটে প্রতি মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার জামদানি শাড়ি বেচা-কেনা হয়। ঈদকে সামনে রেখে এ মাসে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার জামদানি বেচা-কেনা হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

আপনি আরও পড়তে পারেন