আমনের মাঠে মাঠে চলছে সোনালী ধান কাটার উৎসব দাম ও ফলনে খুশি কৃষক

আমনের মাঠে মাঠে চলছে সোনালী ধান কাটার উৎসব দাম ও ফলনে খুশি কৃষক
সানজিদা, দামুড়হুদা ( চুয়াডাঙ্গা)  প্রতিনিধিঃ
ঘরে ঘরে চলছে   বাঙালির ঐতিহ্য  নবান্নের প্রস্তুতি ,বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়ায় এ দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন- জীবিকা কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল।চুয়াডাঙ্গা জেলার চার উপজেলার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বাম্পার ফলন হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
বর্তমানে জেলার সকল আমনের মাঠে মাঠে চলছে সোনালী ধান কাটার উৎসব।ফসলের মাঠের কাঁচা- পাকা সোনালী ধানের শীর্ষে দুলছে  কৃষকের  স্বপ্ন । ফসলের মাঠ থেকে কৃষকরা তাদের জমি থেকে সকল ধান গুচিয়ে  শুকানো সহ  মাড়াই করার মধ্যে আবহমান গ্রাম- বাংলার  ঐতিহ্য ধরে রাখতে  প্রতিটি কৃষক পরিবারে ঘরে ঘরে  আর কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হবেন বাঙালির নবান্ন উৎসব।
চুয়াডাঙ্গা  জেলার তিন ফসিল জমি সহ  উর্বর ভূমির কারণে ফসল উৎপাদনের ভান্ডার বললে ভুল হবেন না।এ জেলার চারটি উপজেলার কৃষি ফসল উৎপাদনের উপর নির্ভর হয়ে থাকেন কৃষকেরা।ফলে  জেলার চারটি উপজেলার সিংহ ভাগ মানুষ কৃষি উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত।ধানের মতো উৎপাদিত সকল ফসল কৃষকেরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকি ফসল গুলো  বাজারে বিক্রি করে আর্থিক ভাবে সচ্ছলতা আনেন কৃষক পরিবারগুলো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, চুয়াডাঙ্গা  কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলাতে  রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিলেন ৩৪ হাজর ৭’শ ২৯ হেক্টর জমিতে।তবে এবারে জেলার সেই লক্ষ্যমাত্র ছাড়িয়ে আবাদ করা হয়েছে ৩৫ হাজর ১’শ ৮৮ হেক্টর জমিতে।যার মধ্যে জেলার সদর উপজেলায় ৬ হাজার ২’শ, আলমডাঙ্গায় ১৬ হাজর ৫’শ ১২, দামুড়হুদায় ৭ হাজার ১’শ ৫৫ ও জীবননগর উপজেলায় ৬ হাজর ২’শ হেক্টর জমিতে আমনের এ ধান চাষ করেছেন কৃষক ভায়েরা, ফলন ও ভালো পাশাপাশি ধানের বাজার সহ বিচালির দাম   ভালো পাওয়ার জন্য খুশি জেলার কৃষক বন্ধুরা।   আমন ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের সাথে সাথে আনন্দিত কৃষি বিভাগ।নির্ধারিত  লক্ষ্যমাত্রার চাইতেও বেশি উৎপাদন করেছেন কৃষকরা। ইতি মধ্যেই জেলার সকল উপজেলার বিভিন্ন ফসলের মাঠে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ শুরু হয়েছে।কাজে ব্যাস্ত রয়েছেন কৃষক – কৃষাণী সহ পরিবারের অন্যআন্য সদস্যরাও।
জেলার সকল উপজেলার বিস্তীর্ণ  ফসলের মাঠ জুড়ে সেনালী ও সবুজ রঙের ধান শোভা পাচ্ছে।কীটনাশক, সার ও সেচ ব্যবহার করে অল্প সময়ের মধ্যে আমন জাতের ধান লাগিয়ে লাভবান কৃষক । ফলে আগামীতে এ জেলাতে আরো বেশি বেশি এ জাতের ধানের চাষ বৃদ্ধি পাবেন। রোগ বালাই কম,ফলনও ভালো হয়েছেন বলে দাবি কৃষকেদের।
দামুড়হুদা উপজেলার  বিভিন্ন ধানের মাঠে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,
আমনের সোনালী ধানের  ফসল বাতাসে দোল  খাওয়া পাকা ধানের গন্ধে বিমোহিত  কৃষক বন্ধুরা।আনন্দে চোখে মুখে নেই ক্লান্তির ছাপ।বাতাসের গাছে গাছে শিন শিন শব্দে তাদের মননকে প্রাণবন্ত করছে।পাকা ধানের এমন শব্দে জেলার মাঠে মাঠে ধান কাটা, মাড়াই মনোরম  দৃশ্য দেখে দৃষ্টি ফেরানোয় দায়।
ফজরের  আযানের ধ্বনি কৃষকদের কানে যাওয়া মাত্র ভোরের   শিশির উপেক্ষা করে পাখি ডাকা ভোরে কৃষক ভায়েরা দল বেধে মাঠে ছুটছেন ধান কাটার জন্য। রক্ত রঙা সূর্য আকাশে উঁকি দেওয়া থেকে শুরু করেন ফসল কাটার কাজ।আর এভাবেই প্রতিদিন চলছে কৃষকের স্বপ্নের ফসল ঘরে তোলার প্রস্ততি। মাঠের ফসলের ক্ষেতে ধানের আঁটি বাঁধা সারিবদ্ধ লাইন।সেই ধানের বোঝা কৃষক মাথায় নিয়ে আইল বেয়ে উঠে আসছেন ফসিল জমির মাঠ ছেড়ে এমন   মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।এরপর কৃষক তা পাওয়ার টিলার , ভ্যান, সাইকেল করে নিচ্ছেন বাড়ির  উঠানে।এরপর সময় সুযোগ বুঝে বাড়ি, খেলার মাঠ বা আম বাগানের উঠানে মাড়াই করছেন।কেউ কাটছে ধান আবার কেউ বা বাঁধছে বোঝা,কেউ ঝাড়ছেন ধান, কেউ বা কুলা দিয়ে উড়াচ্ছেন।এরপর  ঘরে শুকিয়ে তুলছেন। শুকনো ধান থেকে চাল তৈরি করতে কৃষাণী বড় বড় হাঁড়ি বা জালাতে  সিদ্ধ করে রৌদ্রে শুকানোর জন্য মেলে দিবেন।সিদ্ধ করা ধান রৌদ্রে শুকানোর পর ধান ভাঙ্গিয়ে চালে রুপান্তর করা অবধি পর্যন্ত কৃষাণী সহ কৃষক পরিবার ব্যস্ত সময় কাটিয়ে থাকেন।নতুন ধানের নতুন চাল ঘরে আসার পর গ্রামীণ জনপদের শুরু হবেন বাঙালির ঐতিহ্যবাহি উৎসব নবান্ন।
 কৃষকদের  মাধ্যমে জানা গেছে, বিগত বছরের তুলানায় এ বছর ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছেন।বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৭ মন করে ধান হয়েছে। উপজেলার মাঠে মাঠে চলছে  পুরোদমে  ধান কাটার উৎসব।চলবে অগ্রহায়ণ  মাসের শেষ  পর্যন্ত ।এ বছরে আমনের মাঠে সামান্য পোকার আক্রমণ দেখা  মিললেও ফসলের  তেমন ক্ষতি করতে পারেনি বলে জানা গেছেন  উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় থেকে  ব্লক সুপারভাইজাররা কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়েছেন।তাদের দাবি  আগামীতে এ জেলার আমান ধানের এ জাতের চাষ আরো বৃদ্ধি পাবেন।তবে পানি, সার, বীজ, কীটনাশক সহ তেলের দাম বৃদ্ধি হওয়ার কারণে চাষ করতে বেশি খরচ হয়েছে বলে জানান চাষিরা। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হওয়ায় সাথে  বাজরে ধানের দামের পাশাপাশি বিচালির দাম থাকাতে  উৎপাদনের তুলনায় লাভবান হবেন বলছেন চাষিরা।
বাংলা মাসের ক্যালেন্ডারের কার্তিক পেরিয়ে চলছে অগ্রহায়ণ। আর এরই মধ্যে পড়েছে হেমন্ত।সকাল সন্ধ্যার হেমন্তের মিহি কুয়াশা জানান দিচ্ছে নবান্ন উৎসবের।
দেশের ষড়ঋতু’র চতুর্থ ঋতুকে বলা হয় হেমন্ত।ইংরেজি মাসের নভেম্বর – ডিসেম্বর অর্থাৎ বাংলা মাসের  কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এ দু মাসের সমন্বয়ে গঠিত।বাংলা ঋতু’র অগ্রহায়ণ মাসে কৃষকদের ঘরে ঘরে ওঠেন নতুন ধান।ফসলের মাঠে কৃষকের  নতুন স্বপ্ন রচিত হয়।
নতুন ধান কাটার পর পর তা থেকে নতুন চালের পিঠা বানানোর ধুম পড়েন গ্রামীণ জনপদের পাড়া-মহল্লায়।হাজার বছর আগে কৃষি কৃষি প্রথা চালু হয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়। আর তখান থেকেই কৃষক পরিবারের কৃষক – কৃষাণীরা তাদের ছেলেমেয়ে সহ আত্মীয় স্বজনদের সাথে নিয়ে এ উৎসব আয়োজন করতেন।ফলে তখনকার সময় থেকেই বাঙালির ঐতিহ্য উৎসব নবান্ন পালন হয়ে আসছে।
 এটি দেশের বাঙালির জাতির জন্য এটা সংস্কৃতি। আর সংস্কৃতির একটা বিশেষ পর্ব লোকজ উৎসব।নবান্ন বলতে আমারা সকলেই কম বেশি জানি তা হলো, সদ্য নতুন ধান কাটা, ধানের চালের অন্ন। নবান্ন শব্দের অর্থ বলতে আমরা বুঝে নতুন চালের ভাত।নতুন ফাল ঘরে তোলার আনন্দে গ্রামীণ জনপদে কৃষকদের পরিবার তাদের সন্তান, জামই মেয়ে সহ নিকট আত্মীয়দের একত্রিত করে এ  উৎসব পালন হয়ে আসছেন যুগ যুগ ধরে।
তাইতো -বাংলা সাহিত্যে জসিম উদ্দিনের লেখা কাব্যগ্রন্থ গান,কবিতা,নাটক প্রভৃতি সবই পল্লি কবি বা গ্রামকে কেন্দ্র করে। পল্লি সমাজের উন্নয়নে  তার অবদানের কথা অনস্বীকার্য। তা-ই তো কবিকে এ সকল অবদানের জন্য তাকে পল্লিকবি বলা হয়ে থাকেন।
 তা-ই তো কবি জসিম উদ্দিন নতুন ধান কাটার আর হেমন্তকে নিয়ে লিখেছেন- ‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান/ সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান / ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা,গন্ধ উড়ায় বায়ু/ কলমি লতায় লেন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু’।হেমন্তের অন্য নাম নবান্ন।
একসময় বাংলার বছর শুরু হত হেমন্ত দিয়ে।কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এ হেমন্ত নবান্ন মানেই চারদিকে পাকা ধানের ম ম গন্ধ আর নতুন অন্ন, গ্রামের ফসলের মাঠে চলে ধান কাটার ধুম, হেমন্তের এ ফসল কাটাকে কেন্দ্র করে কৃষকদের ঘরে শুরু হয় নবান্নের উৎসব।গৃহস্থাবাড়িতে নতুন ধানে তৈরি পিঠাপুলির সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়।বাংলার কৃষকের আঙ্গিনা ভরে দেয় সোনালী সষ্যা
কানাইডাঙ্গা গ্রামের কৃষক মোস্তফা কামাল বলেন,প্রতিবছরই তার  ৪-৫  বিঘা করে  ধান থাকেন।এবাও প্রায় ৪ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন তিনি।সার, বীজ,পানি  সহ কীটনাশকের দাম বেশি হাওয়ায় কারণে এবার খরচ একটু বেশি হয়েছে দাবি এ কৃষকের ।তবে ধানের বাজার ভালো। ধান একটু কাঁচা রয়েছে  সব ঠিক থাকলে আর ৮-১০ দিনের  মধ্যে ধান কাটাবেন এ কৃষক।তিনি আরো বলেন,প্রথম দিকে ধানের দাম বেশি ছিলেন। শুনছি একটু কমেছে,এরপরও   ধানের বর্তমান বাজারের মতো দাম পেলে সব খরচ মিটিয়ে লাভবান হবেন তিনি সহ সকল কৃষক সমাজ।
এবিষয়ে  চিৎলা গ্রামের  কৃষক  আতিয়ার রহমানের সাথে কথা হলে তিনি বলেন,এ বছরে প্রায় ২ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন।২-৪ দিনের মধ্যেই ধানা কাটা শুরু করবেন তিনি।এরপর মাড়াই সহ অন্যআন্য কাজ শেষে ধান থেকে চাল উৎপন্ন শেষে নতুন ধানের অন্ন গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু  হবেন গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব নবান্ন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের  অবসরপ্রাপ্ত  কর্মচারী আশরাফ আলী বলেন,নতুন  ধান কাটা উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী ধান বা পিঠার উৎসব।এসময় গ্রামের বধূরা জামাইকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়িতে নবান্ন উৎসব পালন কররা জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন।তিনি আরো বলেন, আজকে নাগরিক সভ্যতার জাঁতাকলে আবহমান কালের ঐতিহ্য বাংলার সংস্কৃতি অনেকেটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আগে কার  মানুষের এ প্রথায় মানুষের বন্ধন দৃঢ় ছিলেন।আগের সমাজ ছিলেন উৎসব মুখর সমাজ। সবাইকে সবার প্রয়োজন পড়ত। মানুষের মাঝে একে অপরের  সম্পর্ক ছিলেন সহজ-সরল। ভাই – বোন সহ নিকটাত্মীয়ের মধ্যে ছিলেন আত্মার বন্ধন।অতচ আজকে আগের দিনের মতো সমজ সম্পর্কগুলো আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে যাচ্ছেন।
 ইতিমধ্যে জেলার স্থানীয় বাজারে  উঠতে দেখা গেছেন আমন জাতের ধান ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছেন। এসকল ধানের মন বিক্রি হচ্ছেন ১১৮০ থেকে ১৩৫০ টাকা পর্যন্ত  মন। বাজরে চাউলের দাম বেশি হওয়ার ফলে আগামীতে ধানের দাম বৃদ্ধি পেতে পারেন বলে জানিয়েছেন ধান- চাল  ব্যবসায়ীরা।গত বছরের চাইতে এবছর ধানের দামের মন প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ২০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত।ফলে ধান চাষিরা উৎপাদন খরচ বাঁচিয়ে লাভবান হচ্ছেন।
 কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গা কার্যালয়ের উপ- পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন,বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকার।দেশের কৃষি খাতকে  গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্তি পরিশ্রমে অভাবনীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে উন্নয়ন ঘটেছেন।কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে  আজকে বিনামূল্যে সার,বীজ বিতরণ করা  হচ্ছে।সারা দেশের ন্যায় চুয়াডাঙ্গা জেলার চার উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের ব্লক সুপারভাইজারগণ কৃষকদের নিয়ে  উদ্বুদ্ধকরণ সভা করছেন।তিনি আরো বলেন, জেলার কৃষক ভাইদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতায় এবার লক্ষ্য মাত্রর চেয়ে বেশি ধান চাষ হয়েছেন। জেলাতে বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষক বন্ধুরা খুশি।তাদের এ খুশিতে কৃষি বিভাগ পক্ষ থেকে আমরাও আনন্দিত।

আপনি আরও পড়তে পারেন