মিশন ইমপসিবল সবে শুরু

দক্ষিণ আফ্রিকা জয়ের পর বেশ ফুরফুরে আছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। গতকাল সময় কাটিয়েছেন পরিবারের সঙ্গে।

লন্ডনে যে হোটেলটায় আছে বাংলাদেশ দল, সেটা টেমস পারের পার্ক প্লাজা রিভারব্যাংক। রাস্তার ওপারে পেভমেন্টে দাঁড়িয়ে দুপাশে দৃষ্টি বোলালেই চোখে ধরা পড়ে লন্ডনের বিবর্তন, ভিক্টোরিয়ান আর্কিটেকচার ফেলে একালের আধুনিক স্থাপত্য গায়ে চড়াচ্ছে। ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মও সমানতালে পাল্টে যাচ্ছে। উপমহাদেশীয় আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা আমাদেরও গত কদিনের গরমে ঘাম দিচ্ছে। তবে হঠাৎ করেই পরশু রাত থেকে লন্ডনের চেনা হিমেল হাওয়া। কাল সকালে টিম হোটেলের সামনে দাঁড়াতেই টেমস থেকে উঠে আসা হাওয়ায় গা জুড়িয়ে যাবে যে কারোরই। আর মন জুড়িয়ে গেছে এক এক করে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসা ক্রিকেটারদের দেখে, বিশ্বকাপের প্রথম রাতের উদ্বেগ ধুয়ে-মুছে গেছে দারুণ জয়ে। হিমেল হাওয়ায় সুখী সব মানুষের মুখ—বাংলাদেশ ক্রিকেটের এমন ‘স্থাপত্য’ ভিক্টোরিয়ান প্রাসাদ দেখার চেয়েও প্রীতিকর।

বিশ্বকাপের মতো আসরে বাংলাদেশের মিডিয়া কন্টিনজেন্ট বহুকাল ধরেই ভারতীয়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসছে। এবার প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই। সকাল থেকেই হোটেলের সামনের খোলা উঠানে তৈরি, দলের সুখী চেহারার ছবি নিতে। আগের রাতেই লন্ডনে এসে পৌঁছেছে মাশরাফি বিন মর্তুজার পরিবার। মিডিয়ার ভিড়টা আঁচ করে থাকবেন বলেই কিনা, হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে সপরিবারে বেরিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। তবু ‘ধরা’ পড়ে গেছেন ক্যামেরার লেন্সে। তাঁর আগে সাকিব আল হাসান পরিবারসহ ঘুরতে বেরিয়েছেন ট্যাক্সিতে, একেবারে হোটেলের সদর দরজা থেকে। স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলেকে নিয়ে দ্রুতই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছেন মাহমুদ উল্লাহ। কোচ স্টিভ রোডসও ঘুরতে গেছেন স্টেডি বান্ধবীসহ। ছবির জন্য সামান্য পোজ দিয়েছেন, এর বেশি কিছু নয়। তবে তাঁদের প্রত্যেকের চোখেমুখের সেই উদ্বেগ উড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে প্রশান্তি।

অগত্যা মিডিয়ার ‘দাবি’র মুখে মিডিয়ার সামনে এসেছেন বাংলাদেশ ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ। নিজে দুটি বিশ্বকাপ খেলেছেন। এবারেরটিসহ আরো দুটি বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে ভিন্ন ভূমিকায়। তার চেয়েও বড় কথা অবিশ্বাস্য স্বপ্নবিলাসী মানুষ মাহমুদ। যা এত দিন দলের আনাচে-কানাচে উচ্চারিত হয়েছে, গতকাল সেটিই প্রকাশ্যে বললেন মাহমুদ, ‘আমরা এখানে এসেছি জিততে। আমাদের লক্ষ্য সেরা চার দলের একটি হওয়া। আমাদের সে সামর্থ্য আছে। গতকাল (পরশু) আমরা ভালো ক্রিকেট খেলেছি। তার পরও বলব এর চেয়ে ভালো ক্রিকেট খেলার সামর্থ্য ছেলেদের আছে। যদি এ ধারা ধরে রাখতে পারি তাহলে সেমিতে উঠতে পারব না কেন?’

১৯৯৯ বিশ্বকাপে ওয়াসিম আকরামকে কটাক্ষ করার দুঃসাহস দেখানো মাহমুদ কি ফিরে এলেন নাকি আবার লন্ডনে? কথাবার্তায় তো সে রকমই আগ্রাসন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আমরা দারুণ ব্যাটিং করে ৩৩০ রান করেছি। আরেক দিন ২৩০ রানেও অল আউট হয়ে যেতে পারি। তবু জেতার জন্যই মাঠে নামব। তা না হলে খেলে লাভ কী?’

বাংলাদেশ দলের অভিজ্ঞতা এবং সাম্প্রতিক ফর্মই খেলোয়াড়ি জীবনের মতো দুঃসাহসী করে দিয়ে থাকবে মাহমুদকে, ‘আমাদের স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের চারজন দারুণ অভিজ্ঞ। বোলিংয়ে মাশরাফি এবং সাকিব চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলছে। সবচেয়ে আশার কথা মুস্তাফিজও সেরা ফর্মে ফিরছে। নেটে ও যে কী বোলিং করছে! আমি তো বলব দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে ওর ৮০ ভাগ আপনারা দেখেছেন। মিরাজ এবং অন্যরাও ভালো বোলিং করেছে। অভিজ্ঞতার ঘাটতি নেই, সবাই ফর্মেও আছে।’ বাংলাদেশ দলের রিজার্ভ বেঞ্চও ‘গরম’, ‘রুবেল, লিটনের মতো খেলোয়াড়রা সুযোগ পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আমরা যে অবস্থায় আছি, তাতে ভালো কিছুই আশা করছি।’

ম্যানেজারের আশাবাদের সংক্রমণ ঘটেছে আশপাশে ভিড় করা প্রবাসী এমনকি, সংবাদকর্মীদের মনেও। হবে না কেন? আগের ৩৬২ ওয়ানডেতে মাত্র ১৩ বার তিন শ রান করা বাংলাদেশ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই নতুন রেকর্ড গড়বে, কে ভেবেছিল? বাংলাদেশের দলীয় পরিকল্পনায় তিন শর ছক ছিল। কিন্তু ছক কাটা আর সে মতে মাঠে পারফরম করা এক জিনিস নয়। সে রকম হলে তো তিন শ নিয়ে এত গবেষণা হতো না বাংলাদেশ দলে।

বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক এখন লন্ডনে আইসিসির দূত হিসেবে। উঠেছেন টিম হোটেলেই। পরশু মাঠে ম্যাচ দেখেছেন বিশ্ব ক্রিকেটের সাবেক মহারথীদের সঙ্গে বসে। নাম বলেননি কারোর, সঙ্গে বৈশ্বিক ক্রিকেটে যে রবিবার জোর ধাক্কা দিয়েছেন সাকিব-মুশফিকরা, সে গল্প বেশ জমিয়ে বলছিলেন রাজ্জাক, ‘সকালে ওখানে বসে খুব একটা ভালো লাগছিল না। সবাই কেমন অবজ্ঞাই করছিল বাংলাদেশকে, একমাত্র জ্যাক ক্যালিস ছাড়া। বাংলাদেশ ৩৩০ রান করার পরও কারো হুঁশ হয়নি। জেপি দুমিনি আউট হওয়ার পরই দেখলাম সবাই বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছে! তখন খুব মজা লাগছিল।’

বৈশ্বিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ‘ভাবমূর্তি’ সত্যিই বিস্ময়কর। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে অধিনায়কদের ফটোশ্যুটের সময় মাশরাফিকে একাধিক অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘গত বিশ্বকাপের পর থেকে তোমরা ৯টি সিরিজ জিতেছ, দারুণ ব্যাপার!’ অথচ তাঁদের পূর্বসূরিদের কাছে কোনো সমাদর নেই মাশরাফিদের। নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম তো বলেই দিয়েছেন, ‘বড়জোর একটি ম্যাচ জিতবে বাংলাদেশ।’ বিপিএল সূত্রে ‘ম্যাকা’ বাংলাদেশ অধিনায়কের বন্ধুতুল্য। সেই বন্ধুতার সূত্রেই যে ম্যাককালামের পূর্বাভাসে আহত হননি মাশরাফি, তা নয়। তাঁর জীবনদর্শনই শিখিয়েছে এ জাতীয় অবজ্ঞা, সমালোচনার জবাব মাঠেই দিতে, ‘কে আমাদের নিয়ে কী ভাবছে, সেসব নিয়ে আমাদের ভাবার সময় নেই। আমরা নিজেদের নিয়ে ভাবি। পরের ম্যাচে কিভাবে আরো ভালো খেলা যায়, সেদিকেই সবটুকু মনোযোগ দিচ্ছি।’

ভাবছিলাম, অধিনায়ক শুরু থেকেই সব ভুলে নিজেদের উন্নতির ওপর জোর দিয়ে আসছেন। গতকাল ম্যানেজারও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের চেয়েও পরেরগুলোয় ভালো খেলার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। যদি তা সত্যি সত্যি ঘটে যায়, তাহলে…?

প্রথম ম্যাচ জয়ের পর মাশরাফির উত্তরটাই এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, ‘মাত্র তো একটি ম্যাচ জিতেছি। এত লম্বা টুর্নামেন্টে এই জয়ের কোনো গুরুত্বই থাকবে না যদি পরেরগুলোয় ভালো না খেলি।’

তার মানে, আকাশে স্বপ্নের ঘুড়ি উড়িয়েও পা মাটিতেই রেখেছে বাংলাদেশ দল। ‘মিশন ইম্পসিবল’ যে মাত্রই শুরু হলো!

আপনি আরও পড়তে পারেন