কেরানীগঞ্জে সিসা গলানোর কারখানার দূষিত ধোঁয়ায় ঘরে থাকাই দায়

কেরানীগঞ্জ উপজেলায় অবৈধ ভাবে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি নষ্ট, বাতিল ব্যাটারি ও পুরোনো লোহার বর্জ্য সংগ্রহ করে সিসা গলানোর কারখানা। এর ক্ষতিকারক ধোয়ায় দূষিত হচ্ছে চারপাশের পরিবেশ, ক্ষতি করছে মানব দেহের, নষ্ট করছে ফসল ও জমি। শুধু যে কারখানার বিষাক্ত ধোয়ায় আশপাশের পরিবেশ নষ্ট হয় তা নয়, এখানে কর্মরত কর্মচারীরাও রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।

গত কয়েক বছর ধরে উপজেলার শুভাঢ্যা ও বাস্তা ইউনিয়নের আহাম্মদ নগর,রতনের খামার, কুমলি, কাজির গাঁও, ও বিল কাঠুরিয়া গ্রামসহ উপজেলার শাক্তা ও রোহিতপুর ইউনিয়নের কয়েকটি জায়গায় বিভিন্ন পুরাতন লোহার বর্জ্যের কারখানাগুলোতে সিসা পোড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী ।

সরেজমিনে জানা যায়, কোন প্রকার অনুমতি ও পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে পরিবেশ বিরোধী এ কারখানাগুলো। এসব কারখানায় বাতিল ব্যাটারি ও বিভিন্ন লোহার জিনিস পত্র পুড়িয়ে সিসা বের করা হয়। এগুলো গলিয়ে সিসার পাটা তৈরি করা হয়, যা পরবর্তীতে চড়া দামে বিক্রি করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি কারখানায় মালিক ও কর্মরত কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুলিশকে প্রতি মাসেই মালিক পক্ষের থেকে মাসোহারা দেয়া হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে পুলিশ আসলেই চা নাশতার জন্য খরচ দেয়া হয়। আর স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকর্মী প্রায়ই এসে চাঁদা নিয়ে যায়। তাই কারখানা পরিচালনা করতে তেমন সমস্যা হয় না।

এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। তাদের মধ্যে একজন কাঁজির গাঁও এলাকার নারায়ণ বলেন, কারখানাগুলির পাশেই চারিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আহাম্মদ নগর মসজিদ, মাদ্রাসাসহ অসংখ্য বাড়িঘর আছে। ব্যাটারি পোড়ানোর সময় বেশি ক্ষতি হয় বিদ্যালয়ে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের। আশেপাশে যারা বসবাস করে তাদের স্বাস্থ্যের জন্যও এ কারখানাগুলো খুবই ক্ষতিকর।

তিনি আরও জানান, এর আগে আহাম্মদ নগর, কুমলি, কাজির গাঁও, ধীৎপুর, বিল কাঠুরিয়া গ্রামগুলোর সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে বেশ কয়েকবার কারখানাগুলোর মালিকদেরকে অনুরোধ করেছি এবং আমাদের সকলের অসুবিধার কথা জানিয়েছি তবুও তারা আমাদের কথার কোন গুরুত্ব দেয়নি। বেশ কয়েকবার অনুরোধ ও বন্ধ করার কথা বলার কারণে কারখানার মালিকেরা উল্টো গ্রামবাসীদের পুলিশ দিয়ে হয়রানি করিয়েছেন।

এ ব্যাপারে আহাম্মদ নগরবাসী মো. ইউনুছ (৭০) নামের এক বৃদ্ধ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি খুবই গরিব মানুষ। সংসার চালানোর জন্য অনেক কষ্ট করে ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ২ টি গরু কিনেছিলাম। আমার ছোটবড় মিলিয়ে মোট ৮ টি গরু ছিল। আমার একটি হাত নাই তাই গরুগুলোকে ঘাস কেটে খাওয়াতে পারি না। সারা দিন মাঠেই দিয়ে রাখতাম। কয়েক মাস আগে সিসার কারখানার পাশে থাকা ঘাস খেয়ে ছোটবড় মিলিয়ে মোট ৬ টি গরু আমার চোখের সামনে মারা গেল। এখন আমি প্রায় নিঃস্ব বললেই চলে, আমি এখন কিভাবে এ ঋণ শোধ করব ভেবে পাচ্ছি না।

একই অভিযোগ করে স্থানীয় মোহাম্মদ আলী (৩৫), মো. হেমায়েত (৫৫) ও মো. মুকবুল (২৭) বলেন আমরা খুবই গরিব আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে গরু গুলো কিনেছিলাম এই কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের তিনজনের ৩ টি ও ইউনুছ মিয়ার ৬ টি গরুসহ মোহাম্মাদ আলীর ১ টি খাসি মরে গেছে।

স্থানীয় আরেক যুবক অভিযোগ করে বলেন সারা দিন কাজ করে বাসায় ফিরে রাস্তায় বা কোন চায়ের দোকানে বসি। বিষাক্ত ধোঁয়ার গন্ধে সেখানে বসাও অনেক কষ্টকর হয়ে যায়, এমনকি ঘরের ভেতরেও এ ধোঁয়ার গন্ধে থাকা কষ্টকর হয়ে যায়। এসব ধোঁয়া আমাদের নিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে খুবই ক্ষতি করে আমাদের, রাত হলেই যেন আরও বেড়ে যায় এ ধোঁয়ার গন্ধ ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সিসার বা সিসার ধোয়ার কারণে থাইরয়েডের সমস্যাটা বেশি হয়, এটি শিশুদের ব্রেইন ডেভেলপমেন্টে প্রভাব ফেলে, ফুসফুসে সমস্যা সৃষ্টি করে, রক্তশূন্যতা সৃষ্টি করে, গর্ভবতী মহিলাদের জন্যও ক্ষতিকর, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর শিশুদের জন্য। এ সকল কারখানায় যে সকল শ্রমিকেরা কাজ করে তাদের জীবনও মারাত্মক হুমকির মুখে থাকে। এ ধরনের কারখানাগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোন ভাবেই হওয়া উচিত নয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক মাহমুদা খাতুন বলেন, সিসার কারখানা করতে হলে অবশ্যই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি লাগে, এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান লাগে। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া বা প্ল্যান ছাড়া কোন কারখানা চালায় তা হলে তাকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা ২ বছর থেকে ৫ বছর কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এই ধরনের কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করলেই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ জামান বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নাই । কোথাও সিসার কারখানা থাকলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার অমিত দেবনাথ বলেন, আগে কিভাবে সিসার কারখানা চলেছে তা জানি না, তবে এখন থেকে কেরানীগঞ্জে ক্ষতিকারক কোন সিসার কারখানা থাকবে না। কোথায় কোথায় কারখানা আছে তার লিস্ট করে আমরা অচিরেই এগুলো বন্ধ করে দেব।

আপনি আরও পড়তে পারেন