অর্থ আয়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে মূল দায়িত্বে নজর দিতে পারছে না রাজউক

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অর্থ আয়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে মূল দায়িত্বে নজর দিতে পারছে না। এতে একদিকে যেমন রাজউকের আওতাধীন এলাকায় নিয়মবহির্ভূত ভবন গড়ে উঠছে, অন্য দিকে অল্প ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙায় এগোচ্ছে না।

তবে সাভারের রানাপ্লাজা ধস, বনানীর এফআর টাওয়ারের মতো ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটলে নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। পরে কিছুদিন যেতে না যেতেই আগের রূপে ফিরে আসে।

ফলে অনিয়মকারীরা যেমন ছাড় পাচ্ছেন, তেমনি নতুন করে অনেকেই অনিয়ম করার উৎসাহ পাচ্ছেন বলেও মনে করছেন নগরবিশেষজ্ঞরা।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, নিয়মবহির্ভূত ভবন ভাঙার পাশাপাশি অবৈধ হাউজিং কোম্পানির বিলবোর্ড উচ্ছেদ অভিযান নিয়মিত চালানো হচ্ছে। এর সঙ্গে নতুন নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে আবাসন সংকট দূর করতে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে।

ইতোমধ্যে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় কমবেশি ১৫ হাজার জনকে চূড়ান্তভাবে প্লট বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় বাকি প্লট এখনো বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল আবাসিক এলাকায় প্রায় ১৪ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণকাজ শুরু করেছে রাজউক। ঢাকার তুরাগ তীরে ফ্ল্যাট নির্মাণের জন্য প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিবেশগত সমীক্ষা করতে রাজউক ও চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশনের (সিআরবিসি) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

রাজধানীর উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ২১৪ দশমিক ৪৪ একর জমিতে অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প নেয় রাজউক। ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে মোট ২০ হাজার ১৬০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়। যা প্রকল্পের বরাদ্দগ্রহীতাদের উপস্থিতিতে উন্মুক্ত লটারির মাধ্যমে এ নম্বর দেয়া হয়।

এভাবে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় আবাসন সংকট দূর করার নামে ব্যবসায় নেমেছে সংস্থাটি। এতে প্লট বরাদ্দের মাধ্যমে মুষ্টিমেয় কিছু লোককে বিত্তশালী বানিয়ে দেয় রাজউক।

ফলে রাজধানীর বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী আবাসন সুবিধার বাইরেই থেকে যায়। নগরপরিকল্পনাবিদের মতে, রাজউক নিজেই ফ্ল্যাট নির্মাণে আগ্রাহী হয়ে পড়ায়, কত সংখ্যক নিয়মবহির্ভূত ভবন ঢাকায় নির্মাণ হয়েছে তা অনুসন্ধানে আন্তরিকতা নেই। শুধু অবৈধ ভবনের সন্ধানই করছে। এ জন্য একের পর এক তালিকাও তৈরি হচ্ছে।

কিন্তু অবৈধ ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ হচ্ছে না। রাজউকের অবৈধ ভবনের সন্ধান কিংবা উচ্ছেদ অভিযানের বেশির ভাগই হচ্ছে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার দিকে খুব একটা মনোযোগ দেয়া হচ্ছে না।

ফলে এসব এলাকায় নির্বিচারে চলছে অবৈধ ভবন নির্মাণকাজ। অননুমোদিত নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও কার্যকর হচ্ছে না।

পুরান ঢাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, মূল সড়ক ঘেষে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। আবার কোথাও গলির ভেতরে চলছে এসব নির্মাণকাজ। এগুলোর বেশির ভাগই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মানছে না। রাস্তার জন্য যতটুকু জমি ছেড়ে দেয়ার কথা, ততটা ছাড়া হচ্ছে না।

বরং রাস্তার সীমানা ঘেষে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কেউ আবার ভবনের একতলা ঠিক রেখে, দোতলার আয়তন বাড়িয়ে দিয়ে রাস্তার ওপর চলে এসেছেন। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে রাজউকের খুব বেশি নজরদারি দেখা না মিললেও আবাসন প্রকল্প তৈরিতে বেশ আগ্রহী রয়েছে।

কেরানীগঞ্জ, সাভার ও আশুলিয়ায় যত্রতত্র ঘরবাড়ি উঠে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। এসব এলাকায় রাজউক আবাসন প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পপত্র তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান আমার সংবাদকে বলেন, রাজউকের প্রধান কাজ রাজধানীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প তদারকি করা। কিন্তু সেটি না করে তারা নিজেরাই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প করতে আগ্রহী।

গত বছর রাজউকেরই করা এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল রাজধানীতে ৭০-৭৮ ভাগ ভবন ত্রুটিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে। সে প্রতিবেদনে তারা তাদের গাফিলতির কথা স্বীকারও করে নিয়েছিল।

এক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতার চেয়ে আন্তরিকতার ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরে তাদের জনবলও বেড়েছে। অথচ সংস্থাটির আন্তরিকভাবে কাজ না করার কারণে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প রাজধানীবাসীর জন্য নতুন ভোগান্তি সৃষ্টি করছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশের রাজউক আওতাধীন এলাকায় প্রায় ৬৬ শতাংশ ভবন অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে কোনোটা একেবারেই অনুমোদন নেই, কোনো কোনোটা অনুমোদনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে।

মন্ত্রী আরও বলেন, কোনো কোনো ভবন ভেঙে দেয়া হয়েছে, কোনো কোনো ভবনের আদালতে মামলা রয়েছে এবং কোনোটার আবার ভবন সংশোধন করবেন বলে লিখিত দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, রাজউক আবাসন সংকট দূর করতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। জনগণের সুবিধার্থে বেসরকারি বাজার মূল্যের চেয়ে ফ্ল্যাটের দাম কম হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হচ্ছে না।

বরং আবাসন ব্যবসায়ীদের মতো বাজারদরে ফ্ল্যাট বিক্রি করছে। এ সব বিষয় সম্পর্কে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. সাইদ নূর আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

আপনি আরও পড়তে পারেন