সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে বিলম্বিত হচ্ছে কিবরিয়া হত্যার বিচার

আজ থেকে ১৫ বছর আগের এই বেদনাবিদূর ঘটনা এখনো নাড়া দেয় দেশবাসীকে। আলোচিত বৈদ্যেরবাজার ট্রাজেডির কথা ভুলতে পারেননি কেউ। সেদিনের নির্মম হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। আহত হন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক বর্তমান সভাপতি এডভোকেট মো. আবু জাহির এমপিসহ অন্তত ৭০ জন নেতাকর্মী। বিভাষিকাময় সেই দিনের কথা মনে করে আজো আঁতকে উঠেন আহতরা।

২০০৫ সালের আজকের দিনে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজারে ঈদ পূর্নমিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন হবিগঞ্জ-৩ আসনের তৎকালীন এমপি আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। বক্তব্য শেষে যখন তিনি মঞ্চ থেকে নেমে সহকর্মীদের নিয়ে বৈদ্যেরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেইটে যান তখনই হঠাৎ করেই বিকট শব্দ।

হুড়োহুড়িতে চারদিকে গগনবিদারী চিৎকার। গ্রেনেডের আঘাতে অনেকেই ক্ষতবিক্ষত। কারও দিকে কারো নজর দেওয়ার সময় নেই। এমন সময় দূরে থাকার লোকজন ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। কিবরিয়াসহ আহতদের নিয়ে ছুটে যান হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে। মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। হাসপাতালে তখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। শাহ এএমএস কিবরিয়া ও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহিরের প্রচন্ড রক্তক্ষরণ কোন ভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না।

স্থানীয় প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করা হয় হেলিকপ্টারের জন্য। কিন্তু দ্রুত তা ব্যবস্থা করতে না পারায় সিদ্ধান্ত হয় এ্যাম্বুলেন্সে রওয়ানা দেওয়ার। একই অ্যাম্বুলেন্সে করে কিবরিয়া ও আবু জাহিরকে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। পথিমধ্যে আরও একটি অ্যাম্বুলেন্স পেলে তাদেরকে আলাদাভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা যখন অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছায় তখন চিকিৎসক কিবরিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুতে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা জাতি।

গ্রেনেড হামলায় শুধু শাহ এএমএস কিবরিয়া নন, তার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী প্রাণ হারান।

ঘটনার পরদিন ২৮ জানুয়ারি তৎকালীন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালিন সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে কাজ করে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু মামলাটির স্বাভাবিক তদন্ত না হয়ে দলীয় বিবেচনায় পরিচালিত হতে থাকে।

সিআইডি’র তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২০ মার্চ ১ম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে তৎকালীন জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জেলা বিএনপির তৎকালিন সহ-সভাপতি আবদুল কাইয়ুম, জেলা বিএনপির কর্মী আয়াত আলী, কাজল মিয়া, জেলা ছাত্রদলের সহদপ্তর সম্পাদক সেলিম আহমেদ, জিয়া স্মৃতি গবেষণা পরিষদ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আলী, বিএনপি কর্মী তাজুল ইসলাম, বিএনপি কর্মী জয়নাল আবেদীন জালাল, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা জমির আলী, ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন মোমিন ও ছাত্রদলকর্মী মহিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়।

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২০ জুন আরো ১৪ জনকে আসামী করে আলোচিত এই মামলার অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া চার্জশীটের উপর হবিগঞ্জ জুডিসিয়াল আদালতে নারাজি আবেদন করেন।

আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপ নথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার ৩য় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি সিলেট অ লের তৎকালীন সিনিয়র এএসপি মেহেরুন নেছা পারুল। অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনকে অন্তভর্‚ক্ত করা হয়।

অন্তর্ভূক্ত আসামিরা হলেন- সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গউছ, বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া।

সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার কর জানান, এ মামলায় ১৭১ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ৩২ আসামীর মধ্যে ৩ জন মৃত্যু বরণ করেছেন। ১২ জন আসামী জামিনে আছেন। ১০ জন আসামী হাজতে আর বাকি ৭ আসামী পলাতক রয়েছে।

জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির এমপি বলেন, আমি বেঁচে থাকার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ হলেও এখনো আমার গায়ে গ্রেণেডের শত শত স্পিন্টার। পায়ে স্টিল লাগানো। তবে আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি এটাই বড় কথা। দ্রুত বিচার কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জেলা আ’লীগের প্রভাবশালী এ নেতা।

কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, মামলা নিয়ে এই মুহূর্তে আমরা আশাবাদী না। কারণ আমরা এখনো বিশ্বাস করি, সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে মামলাটা পরিচালিত হচ্ছে না।

মামলার বাদী ও হবিগঞ্জ-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুল মজিদ খান বলেন, নানা আইনী জটিলতার কারণে মামলা র্দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হয়। আমি বাদী, তাড়াতাড়ি শেষ হোক চাই। আমি সরকারী দলের এমপি, সরকারের লোক এবং আমার নেতা নিহত হয়েছেন। তাই আমি চাই এ মামলা কার্যক্রম দ্রুত শেষ হউক।

আপনি আরও পড়তে পারেন