পাপিয়ার দুই টর্চার সেল

  • বাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকার টিনশেড বাড়িতে প্রথম টর্চার সেল
  • কিউ অ্যান্ড সি কারওয়াশ অ্যান্ড সলিউশনে দ্বিতীয় টর্চার সেল
  • টর্চার সেল ও এলাকা নিয়ন্ত্রণে দুই শতাধিক সদস্যের ক্যাডার বাহিনী
  • যাতায়াতের আগে সড়ক নিয়ন্ত্রণে কিউ অ্যান্ড সি গ্রুপ-১০ নারী সদস্য

নারী নেতৃত্বের অন্তরালে শামীমা নুর পাপিয়া অস্ত্র, মাদক ও পতিতাভিত্তিক ব্যবসাসহ দখল, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে গড়েছেন কোটি টাকার সাম্রাজ্য। যে সাম্রাজ্য পরিচালনার কাজে বিরোধীদের মোকাবিলা এবং নির্যাতনসহ বহুমুখী স্বার্থে নরসিংদী এলাকায় গড়েছেন দুটি টর্চার সেলও।

ঢাকার হোটেল ওয়েস্টিনে ডেরার তথ্য এবং ১২ রুশ তরুণীর দেশে প্রবেশের সঠিক কারণ অনুসন্ধানে ধরা পড়ে পাপিয়ার অপরাধ জগতে দাঁপিয়ে বেড়ানোর চাঞ্চল্যকর তথ্য।

তথ্য-প্রমাণসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানার পর এবং ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়ার তথ্য জানতে পেরে দেশত্যাগের মুহূর্তেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বামী ও দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন পাপিয়া।

এরপর থেকেই একের পর এক বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। মুখ খুলতে শুরু করেছেন পাপিয়ার নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীরাও। পাপিয়ার টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার একাধিক ভুক্তোভোগী জানান, নরসিংদীতে পাপিয়ার রয়েছে দুই শতাধিক সদস্যের একটি নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।

৪০-৫০ সদস্যের একটি ট্যাটু সম্বলিত বিশেষ বাহিনীও রয়েছে তার। ওই দুই বাহিনীর সদস্যদের দিয়েই নিজের বিরোধীদের নির্যাতন করা হতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে গড়ে তোলা টর্চার সেলে। দেহ ব্যবসায় রাজি করাতে না পারা নারীদেরও মতের বিরোধিতা করার কারণে নির্যাতন করা হতো ওই দুই টর্চার সেলে।

টর্চার সেলে নির্যাতনের ভয় এবং নির্যাতন করেই অসহায় নারীদের বাধ্য করা হতো পতিতাভিত্তিক ব্যবসায় এবং অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তিদের মনোরঞ্জনে। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা হতো নগদ অর্থও।

স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্র ও বাসিন্দারা জানান, ২০০০ সালের দিকেই নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমনের উত্থান শুরু। শৈশব থেকেই চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ব্ল্যাকমেইল ছিলো তার প্রধান পেশা। দিনে দিনে দূরদর্শী চতুর ও মাস্টারমাইন্ড সুমন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন।

২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পরই আলোচনায় আসেন সুমন। এরই মধ্যে পাপিয়া চৌধুরীকে বিয়ে করে রাজনীতিতে কাজে লাগান।

প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের পর দুর্বৃত্তায়ন রোধকল্পে বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল সন্ত্রাসী সুমন ও তার স্ত্রী পাপিয়া চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে আসতে নিষেধ করলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিভাজনকে কেন্দ্র করে পাপিয়া-সুমন দম্পতি সদর আসনের এমপির বলয়ে যোগ দেয়।

পাশাপাশি ঢাকার সংরক্ষিত আসনের এক নারী এমপির সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে তোলেন। এরপর থেকেই আর এ দম্পতিকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

অস্ত্র, মাদক, পতিতাভিত্তিক ব্যবসা, দখল, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও তদবির বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে এগিয়েছেন দুর্বার গতিতে। ঢাকা ও নরসিংদীতে গড়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, করেছেন সুউচ্চ দালান।

জানা গেছে, নরসিংদী জেলা শহরে বাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকায় একটি পাকা ও আরেকটি সেমিপাকা টিনশেড বাড়ি রয়েছে পাপিয়ার। সেমিপাকা টিনশেড ওই বাড়িটিই মূলত তার প্রথম টর্চার সেল। ওই টর্চার সেলেই পাপিয়া ও তার অনুসারীরা বিরোধীদের ওপর নির্যাতন চালাত।

নরসিংদী জেলা শহরে সুমন চৌধুরীর রয়েছে কিউ অ্যান্ড সি কারওয়াশ অ্যান্ড সলিউশন নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কার ওয়াশ ব্যবসার আড়ালে ওই প্রতিষ্ঠানটিই মূলত তাদের দ্বিতীয় টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহূত হতো।

এছাড়াও সেখানে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাত ভয়ঙ্কর এ নারী পাপিয়া ও তার ক্যাডার বাহিনী। যাদের মাসিক বেতন পরিশোধের ভিত্তিতে দলে রেখেছেন পাপিয়া।

একাধিক সূত্র জানায়, পাপিয়ার টর্চার সেলে অন্তত ২০ জন সদস্য রয়েছেন, যারা নির্যাতনে নিয়োজিত। সেখানে ওই বাহিনীর সদস্যরাই নারীদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতো। পাপিয়ার টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার এক নারী গত বুধবার ঢাকার বিমানবন্দর থানায় সাংবাদিকদের কাছে এমনটাই বলেছেন।

শুধু বলেন-ই নি, তিনি দেখিয়েছেনও— তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে টর্চার সেলে করা নির্যাতনে আঘাতের চিহ্নও। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের কারণে হওয়া ক্ষতস্থানও তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের দেখিয়ে পাপিয়ার টর্চার সেলের ভয়াবহতার বিভিন্ন নমুনাও তুলে ধরেন।

তিনি বলছেন, টর্চার সেলে নির্যাতন করেই তার কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা নিয়েছেন পাপিয়া। পাপিয়ার বিরুদ্ধে আরও এক নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ করে বলেছেন, পাপিয়া তাকে জোরজবরদস্তি করে দেহ ব্যবসায় নিয়ে এসেছেন।

এরকম অভিযোগ বিমানবন্দর থানায় আসছে। এগুলো খতিয়েও দেখা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশের একটি সূত্র। তার বিরুদ্ধে ভুক্তোভোগীদের অনেকেই আবার মামলা করার জন্যও উন্মুখ হয়ে আছেন বলেও জানা গেছে।

পাপিয়ার টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার একাধিক ব্যক্তি ও স্থানীয়রা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নিজেদের অবস্থান শক্ত করতেই পাপিয়া-সুমন দম্পতি এলাকায় গড়ে তুলেছেন কিউ অ্যান্ড সি গ্রুপ নামে একটি বিশেষ ট্যাটু বাহিনী। এ গ্রুপের সব সদস্যদের হাতেই করা থাকে বিশেষ ট্যাটু।

এ গ্রুপে যোগ করার জন্য তার প্রধান টার্গেট ছিলো টিনেজ ছেলেরা। মাসিক ভিত্তিতে বেতন দিয়ে তাদের দলে ভেড়াতেন তিনি। তার ওই গ্রুপে ট্যাটু করা ছেলের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ জন।

এছাড়াও ট্যাটু ছাড়া কর্মীর সংখ্যা ২০০ থেকে ৩০০ জন। এছাড়া পাপিয়ার সাথে সবসময়ই থাকতো প্রায় ১০ জন নারীকর্মী। এলাকায় চলাচলের সময় পাপিয়ার গাড়ি ঘিরে চারপাশে বিশাল যে গাড়িবহর থাকতো, তার মাঝে কালো রঙের গাড়িতেই থাকতেন পাপিয়া।

আর সেই সাথে থাকতো আরো দুটি গাড়ি। মোটরসাইকেল থাকতো অন্তত ২০টি। সড়কে চলার সময় আগে থেকে রাস্তার যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতো কিউ অ্যান্ড সি গ্রুপের সদস্যরা।

এরাই আবার মোটরসাইকেলে বহর নিয়ে তার নিরাপত্তার স্বার্থে সামনে পেছনে টহল দিতো। স্থানীয়রা জানায়, মূলত মাদকবিরোধী অভিযানের সময়ই পাপিয়া-সুমন দম্পতির মাদক ব্যবসায় ভাটা পড়ে। তখন থেকেই তারা মনোযোগ দেয় নির্যাতন করে টাকা আদায়ে।

কিউ অ্যান্ড সি কারওয়াশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি মূলত তখন থেকেই ব্যবহার হতো টর্চার সেল হিসেবে। কিউ অ্যান্ড সি কারওয়াশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওই টর্চার সেলেই নির্যাতনের মাধ্যমে বেশির ভাগ সময় আদায় করা হতো টাকা।

কিউ অ্যান্ড সি কারওয়াশ প্রতিষ্ঠান নামক টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার এক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করে বলেন, তার পৈতৃক সম্পত্তিতে বোনের অংশ কম হওয়ায় পাপিয়ার কাছে নালিশ করেন। এরপর পুরো জমি দখল করে পাপিয়া বোনের নামে করে দেন। যার বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন।

একই টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার অপর এক ভুক্তোভোগী বলেন, একবার ব্যবসার কাজে ঢাকায় যাচ্ছিলাম। বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় তুলে নিয়ে যায় পাপিয়ার লোকজন।

নির্যাতন করার পর ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পাই। পাপিয়া গ্রেপ্তারের কয়েক দিন আগেও অবৈধ কাগজ বানিয়ে এক ব্যক্তির জমি দখলের চেষ্টা করে বলে জানান ওই ভুক্তোভোগী।

র‌্যাব-১ এর কমান্ডার লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল জানান, দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এ দম্পতি। পাপিয়ার স্বামীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বিচারাধীন।

তিনি তার স্ত্রীর মাধ্যম প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় নারীদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন। অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধকর্মের জন্য নরসিংদী এলাকায় তার কুখ্যাতি রয়েছে।

নরসিংদীতে ‘কিউ অ্যান্ড সি কারওয়াশ অ্যান্ড অটো সলিউশন’ নামক প্রতিষ্ঠানটি গাড়ি সার্ভিসিংয়ের আড়ালে তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মাদক ব্যবসার কাজে ব্যবহার করা হয়। নরসিংদী এলাকায় তার একটি ক্যাডার বাহিনী আছে, যাদের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড করে থাকেন।

সেখানে একটি টর্চার সেলও রয়েছে পাপিয়ার। শহরের বাইরে গেলে তার ক্যাডার বহিনী বিশাল গাড়িবহরের মাধ্যমে মহড়া দিয়ে থাকে। বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিপুল অর্থের পাশাপাশি নংসিংদী ও ঢাকায় তার একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লট আছে বলে জানা যায়।

গ্রেপ্তারের পর আদালতে তোলায় এসবের বিস্তারিত তদন্ত করতে পারেনি র্যাব, যে কারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে।

এছাড়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ইতোমধ্যে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পাপিয়া-সুমন দম্পতিকে। পাপিয়ার সঙ্গে যারা অপরাধ করেছে তাদের বিষয়েও তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন।

তিনি বলেন, ‘যারাই অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

আপনি আরও পড়তে পারেন