সিনহা হত্যা: আদেশ পরিবর্তন করে ৭ আসামির ৭ দিনের রিমান্ড

অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপসহ তিন আসামিকে সাতদিন করে রিমান্ডের আদেশ পরিবর্তন করে সাত আসামিকে সাতদিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ হত্যা মামলায় সাবেক ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতসহ সাত আসামির সাতদিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছে আদালত। বৃহস্পতিবার কয়েক দফা শুনানি শেষে রাতে কক্সবাজারের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এ নির্দেশ দেয়া হয়। আত্মসমর্পণের পর আসামিদের কারাগারের পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হলেও পরে র‌্যাব এর রিমান্ড আবেদনের পর মঞ্জুর করা হয় রিমান্ড।

গেলো শুক্রবার রাতে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। করা হয় মামলা। দাবি করা হয় মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের।

আলোচনা সমালোচনায় গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। বুধবার পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয় মামলা। তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র‌্যাবকে। বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান সেনা ও পুলিশ প্রধান। বলা হয় প্রভাবমুক্ত তদন্তের।

পরের দিন বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশের চট্টগ্রাম পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের কথা জানান মামলার অন্যতম আসামি টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ সাহা। পুলিশ প্রহরায় নিয়ে যাওয়া হয় কক্সবাজারে। আগেই আত্মসমর্পণের জন্য আদালতে ছিলেন প্রধান আসামি লিয়াকত সহ অন্য ছয় আসামি।

আদালত জামিন না মঞ্জুর করে নির্দেশ দেন কারাগারেপাঠানোর। কিছুক্ষণ পর র‌্যাব আবেদন করে আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ডের।

শুনানি শেষে প্রদীপ- লিয়াকতসহ তিনজনকে ৭ দিনের অন্য ৪ জনকে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয় আদালত। পরে আবারো পুর্নবিবেচনা করা হয়। আদালতে উপস্থিত ৭ আসামিকেই দেন ৭ দিন করে রিমান্ড।

আদালতে হাজির না থাকা অন্য দুই আসামি এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফার বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা।

প্রদীপ লিয়াকত ছাড়া ৭ দিন র‌্যাবের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হবেন এসআই নন্দ নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং এএসআই লিটন মিয়া।

এর আগে, বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম থেকে পুলিশি হেফাজতে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হয় টেকনাফের প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমারকে। চট্টগ্রাম পুলিশের কাছে আত্মসমার্পন করলে পুলিশ তাকে হেফাজতে নিয়েছে বলে জানানো হয়।

বুধবার টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ ও বাহারছড়া চেকপোস্টের আইসি লিয়াকতসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে কক্সবাজার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন নিহতের বোন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র‌্যাবকে। গত শুক্রবার রাতে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। তদন্তের স্বার্থে গত রোববার টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ সবাইকে প্রত্যাহার করা হয়। আর হত্যা মামলা হওয়ার পর বুধবার ওসি প্রদীপকে প্রত্যাহার করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার সকালে সিনহা রাশেদের মা নাসিমা আক্তারকে ফোন করে সমবেদনা ও সান্ত্বনা জানিয়েছেন। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তেরও আশ্বাস দিয়েছেন।

বুধবার দুপুরে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে যান। তাঁরা কক্সবাজার সৈকতে অবস্থিত সেনাবাহিনীর রেস্টহাউস জলতরঙ্গতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। পরে সেখানে তাঁরা যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। তাঁরা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের নিহত হওয়াকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে দূরত্ব নেই। আর এ ঘটনায় দুই বাহিনীর মধ্যে চিড় ধরবে না।

সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘সিনহার মৃত্যু নিয়ে বাংলাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ যে ঘটনাটি ঘটেছে, তাতে কোনো প্রতিষ্ঠান দায়ী হতে পারে না। তদন্ত কমিটি যাদের দোষী সাব্যস্ত করবে, অবশ্যই তাদের প্রায়শ্চিত্ত পেতে হবে। এ জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের সহযোগিতা করবে না।’

অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘টেকনাফে যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটির কারণে দুই বাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। বরং আমাদের লক্ষ্য হবে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত যৌথ তদন্ত কমিটি হয়েছে, তারা প্রভাবমুক্ত পরিবেশে তদন্ত করবে। তারা তদন্ত করে যে প্রতিবেদন দেবে, সে অনুযায়ী পরবর্তী আইনি কার্যক্রম পরিচালিত হবে এবং সেটাই গ্রহণ করা হবে।’

বুধবার দুপুরে মেজর সিনহা হত্যার বিচার চেয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলাটির শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে তা ‘ট্রিট ফর এফআইআর ’ হিসেবে আমলে নিতে টেকনাফ থানাকে আদেশ দেন আদালতের বিচারক তামান্না ফারাহ। একইভাবে মামলাটি কক্সবাজার র‍্যাব-১৫-কে তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মামলা অগ্রগতির প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

হত্যা মামলার আসামিরা হলেন- টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশস বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের প্রত্যাহার হওয়া পরিদর্শক ও চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার পূর্ব হুলাইন গ্রামের বাসিন্দা লিয়াকত আলী (৩১), উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, পুলিশ কনস্টেবল সাফানুর রহমান, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, টুটুল ও মো. মোস্তফা।

আদালতের নির্দেশে বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফ থানায় মামলাটি (নম্বর সিআর : ৯৪/২০২০ইং/টেকনাফ) তালিকাভুক্ত করা হয়। দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১ ও ৩৪ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলাটি তালিকাভুক্ত করা হয়। টেকনাফ থানার নতুন ওসি মামলাটি তালিকাভুক্ত করেন বলে থানার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে হত্যা মামলা দায়েরের আগেই ওসি প্রদীপ স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে গত ৪ আগস্ট ছুটির আবেদন করেন। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন তার ছুটির আবেদন গ্রহণ করেন বলে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাননি এসপি। মেডিকেল ছুটি নিয়েই ওসি প্রদীপ কক্সবাজার ছেড়েছেন। তাকেসহ মামলার আসামি নয় পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে কি না, জেলা পুলিশ নিশ্চিত করতে পারেনি।

আপনি আরও পড়তে পারেন