মার্কিন নির্বাচন চীনের জন্য ‘বড় উপহার’

চীনের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি উপহারের মতো। করোনা ভাইরাস নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান চীনকে দ্রুত প্রাদুর্ভাব কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। জানুয়ারিতে যখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় তখন থেকেই ট্রাম্প তার প্রশাসনকে ভুলভাবে পরিচালনা করে আসছেন। যার সুফল লুফে নিচ্ছে চীন।

অন্যদিকে ট্রাম্পের ‘অ্যামেরিকা ফাস্ট’ নীতি মার্কিন ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে। তাই চীনকে মোকাবিলায় কোনো জোট গঠন করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

তবে এটা অস্বীকার করা যায় না যে, ট্রাম্প শি জিনপিংকে বিশ্ব রাজনীতির মাঠে নানাভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিলেন। ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতিগুলো কার্যত বাণিজ্য যুদ্ধই বলা যায়। এ সব বাণিজ্য ও প্রযুক্তি যুদ্ধে মার্কিন-চীন সম্পর্ক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সময়ে তাইওয়ানের পক্ষ নিয়ে অস্ত্র বিক্রি ও চীনকে তাইওয়ানে কোণঠাসা করতে ট্রাম্পের চেষ্টা চীনা নেতেদের উজ্জীবিত করেছে। যেটি শি জিনপিং-এর ক্ষমতা পোক্ত করতে সহায়তা করছে। যদিও এ পরিস্থিতি সামাল দেয়া মোটেও সহজ ছিল না শি’র পক্ষে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চীন বর্তমানে যে পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করেছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে দেশ দুটির পক্ষে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সহজ হবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে মতামত জরিপে দেখা যায়, ট্রাম্প উল্লেখযোগ্য হারে পিছিয়ে রয়েছেন। অবশ্য গত নির্বাচনেও ট্রাম্প জরিপ তো বটেই ভোটেও পিছিয়ে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ইলেক্ট্ররাল ভাগ্যের ওপর ভর করে। অপরদিকে জরিপে এবার যেমন বারাক হোসেন ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এগিয়ে রয়েছেন, তেমনি ট্রাম্পের সঙ্গে ইলেক্ট্ররালে হেরে যাওয়া হিলারি ক্লিন্টনও এগিয়ে ছিলেন গত নির্বাচনে।

মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্প বাইডেনের এ লড়াই নিসন্দেহে হাড্ডাহাড্ডি। তবে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই প্রার্থীর এ প্রতিযোগিতা, পাল্টাপাল্টি আক্রমণ মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যেটি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর জন্য ভালো খবর। আর নির্বাচনে হেরে গিয়ে যদি ট্রাম্প ক্ষমতা না ছাড়েন তবে যুক্তরাষ্ট্রে সাংবিধানিক অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে। তখন দীর্ঘ মেয়াদি অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে দেশটি। যার সুযোগ নেবে চীন।

মতাদর্শিক দিক থেকে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একেবারেই বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে। একদিকে মার্কিন গণতন্ত্র অন্যদিকে চীনে এক নায়কতন্ত্র। তাই মার্কিন নির্বাচনের যেকোনো সংঘর্ষ বা অগণতান্ত্রিক দিক চীনের গণমাধ্যম বেশ আনন্দের সঙ্গে প্রচার করবে। নিজেদের জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করবে শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীন ভালোই চলছে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দেশ ভারতের গণতান্ত্রিক সমস্যাগুলোকেও নেতিবাচকভাবে প্রচার করে থাকে চীনের গণমাধ্যম। এতে করে ট্রাম্প যদি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ক্ষমতা না ছাড়েন তার পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী তবে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে সেটিও চীনের জন্য একটি বড় উপহার হবে।

অন্যদিকে ভোটের দিন ডানপন্থি মিলিশিয়াদের হামলা, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোসহ নানা অগণতান্ত্রিক এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যেটি চীনের গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পাবে।

অপরদিকে ট্রাম্প যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে জিততে পারেন তাতেও চীনের লাভ। কারণ হাড্ডাহাড্ডি এ লড়াইয়ে ট্রাম্প জিততে হলে আদালত পর্যন্ত গড়াবে। আর এ জটিল প্রক্রিয়া এবং ভোটের ফল পেতে যে সময় প্রয়োজন তার মধ্যে চলা সংঘর্ষ আর অচলাবস্থাকেও পুঁজি করবে চীন। যদিও ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসলে চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ আরো বেশি কঠোর হবে এবং প্রযুক্তি লড়াইয়ে ট্রাম্প এগিয়ে থাকবেন। কারণ মার্কিন প্রযুক্তি নির্ভর অস্ত্র চীনের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে রয়েছে। তার পরও ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে চীনের জন্যই সুবিধা হবে।

অপরদিকে ট্রাম্প যদি আগের বারের মতো ভোটে হেরে আদালত বা ইলেকটরাল কলেজ ভোটে নির্বাচিত হন তবে তাকে ক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রেই অবৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচনা করবেন বেশিরভাগ ভোটার। বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না মার্কিন মিত্ররাও। এটিকে গুরুত্ব সহকারেই প্রচার করবে চীন পন্থি বা চীনের গণমাধ্যম।

এদিকে পেনসিলভেনিয়া, উইসকনসিন এবং ফ্লোরিডায় জিতলেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। আর এই অঞ্চলে বিচারক নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাম্প নিজে। তাই এসব এলাকায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে মাঠে টিকে থাকতে পারলে ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে বিচারপতি ও নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবেন ট্রাম্প এমন আশঙ্কা এরই মধ্যে ভোটারদের মধ্যে দেখা দিয়েছে। এসব সম্ভাবনা যদি বাস্তব রূপ নেয় তবে, রাজনৈতিক গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে বাইডেনের ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন ট্রাম্প। যার কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতে পারেনি তিনি। তারপরও তদন্ত শুরু হয়েছে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে। তাই ট্রাম্প বিচারবিভাগের অপব্যবহার করছেন বলে মনে করেন অনেকেই।

অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটস এবং রিপাবলিকান উভয়ই চীনকে আমেরিকার সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ কাটিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ মার্কিন গণতান্ত্রিক অস্থিতিশীলতাই মূলত চীনের হাতিয়ার।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের করোনা মোকাবিলায় ‘ব্যর্থতা’এবং এ সময় তার নেয়া পদক্ষেপ ও প্রতিক্রিয়াগুলো চীনকে অর্থনৈতিক যুদ্ধে এগিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটান ট্রাম্প যেটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। ৩ নভেম্বর মার্কিন ভোটাররা ভোট দানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যদিও এবারই রেকর্ড সংখ্যক আগাম ভোট পড়েছে দেশটির নির্বাচনে। তারপরও আনুষ্ঠানিক ভোট আগামীকাল মঙ্গলবার(০৩ নভেম্বর)। তাই এ নির্বাচনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ট্রাম্পের কাছ থেকে আরও একটি উপহার পেতে যাচ্ছেন।

তবে চীনে শি বিরোধী মনোভাব রয়েছে এমন নেতারা জো বাইডেনের বিজয় প্রত্যাশা করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে শি’র খুব একটা ক্ষতি হবে না। অপরদিকে বাইডেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য অনেক কার্যকর ভূমিকা নেবেন বলে মনে করা হচ্ছে। ঘরের মাঠে ভোটের লড়াইয়ে যদি যুক্তরাষ্ট্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তবে, তাদের ঘণিষ্ঠ মিত্ররা অনেক দূরে সরে যাবে যেটি চীনের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করবে মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।

আপনি আরও পড়তে পারেন