সম্মতি ছাড়া সেক্স মানে ধর্ষণ

সম্মতি ছাড়া সেক্স মানে ধর্ষণ

আইন সংশোধন করলো ডেনমার্ক। নতুন আইন বলছে, সম্মতি ছাড়া সেক্স মানেই ধর্ষণ।

তখন মাঝরাত। তাঁর ঘরে একজন লোক ঢোকায় ক্রিস্টিন হোলস্টের ঘুম ভেঙে গেল। তার পরের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। সেই লোকটি ক্রিস্টিনের শরীর পেতে চায়। সমানে বাধা দিয়ে যাচ্ছেন ক্রিস্টিন। লোকটিকে থামতে বলছেন। সে থামছে না।

ক্রিস্টিন জানিয়েছেন, ‘কী হচ্ছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। এর আগে কখনো ওই ব্যক্তির সঙ্গে আমার রোম্যান্টিক সম্পর্ক ছিল না। আমি বারবার নিষেধ করছিলাম। লোকটি সেই কথা কানে তুলছিল না। আমার অসম্মতি মানতে চাইছিল না। এমন সময় সে দুই হাত দিয়ে আমার গলা টিপে ধরে। বুঝতে পারলাম, আমাকে সে মেরে ফেলতে পারে।’

ক্রিস্টিন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন-এ একটি মিটিং-এ যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সেখানেই এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। যাকে তিনি বন্ধু বলে ভেবেছিলেন, সেই বন্ধুই রাতে ক্রিস্টিনের ঘরে আসে।

ক্রিস্টিন বলছিলেন, ‘এরপর আমি আর বাধা দিইনি। আমি ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। শান্ত করার চেষ্টা করেছি। তারপর বুঝতে পেরেছি, সে কিছুতেই থামবে না। তারপর আমার মাথা আর কাজ করেনি। পরের অভিজ্ঞতা খুবই কষ্টকর।’

সম্মতির ভিত্তিতে

সামলে নিতে কিছুটা সময় লেগেছিল। কিন্তু এখন ক্রিস্টিন বলেন, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তিনি পুলিশের কাছে নালিশও জানান। মামলা আদালতে যায়। কিন্তু ধর্ষক ছাড়া পেয়ে যায়। বিচারকরা মেনে নেন, ক্রিস্টিন ওই ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সংসর্গে যেতে চাননি। তা সত্ত্বেও লোকটি তার সঙ্গে যৌন সংসর্গ করেছে। কিন্তু আইনজীবীরা এটা প্রমাণ করতে পারেননি যে, ক্রিস্টিনকে আঘাত করার ইচ্ছা লোকটির ছিল।

ধর্ষিতারা অনেক সময়ই বলেন, সেই সময় ফ্রিজিং হলো খুবই সাধারণ প্রতিক্রিয়া, তা সত্ত্বেও অনেক দেশেই এই ধরনের ঘটনায় ধর্ষকদের শাস্তি দেয়ার কোনো উপায় নেই। ডেনমার্ক সহ অনেক দেশেই ধর্ষণের সঙ্গে সম্মতির বিষয়টিকে জড়িয়ে দেখা হয় না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌন সংসর্গকে ধর্ষণ বলা হয় না। সেখানে অভিযোগকারীকে প্রমাণ করতে হয়, ওই সংসর্গে শারীরিক নিগ্রহ, হিংসা বা জবরদস্তি ছিল। ধর্ষিতা সেই আক্রমণ সহ্য করতে পারেনি। তবেই শাস্তি হয়।

নারী নিগ্রহের প্রতিবাদে মেয়েদের বিক্ষোভ।

কিন্তু সেই নিয়ম অবশেষে বদলাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ডেনমার্কে আইনসভার সদস্যরা ধর্ষণ আইনের সংশোধন অনুমোদন করেছেন। সেখানে কনসেন্ট বা সম্মতিকে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অনুমতি ছাড়া যৌন সংসর্গকে ধর্ষণ বলা হয়েছে। তাতে শারীরিক নিগ্রহ গুরুত্বহীন হয়ে গেছে।

ডেনমার্কের বিচারমন্ত্রী বলেছেন, ‘এবার থেকে ধর্ষিতারা অনেক ভালোভাবে আইনের সুরক্ষা পাবেন। আমরা ধর্ষণ নিয়ে সমাজের ভাবনার পরিবর্তন করতে চাই। তাই সম্মতির বিষয়টি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হয়ে থাকবে।’

লিঙ্গ সাম্যের স্বর্গ?

ডেনমার্ককে বলা হয় ইইউ-র দেশগুলির মধ্যে লিঙ্গ সাম্যের দিক থেকে দুই নম্বরে। একে প্রতিবেশী সুউডেন। এটা হলো ইইউ-র ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অফ জেন্ডার ইকুয়ালিটির তালিকা।

কিন্তু তথাকথিত ‘রেপ কালচার’-এর জন্য ডেনমার্ক সবসময়ই প্রবলভাবে সমালোচিত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে একে ‘বিকৃতমনস্ক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাদের মতে, ডেনমার্কের খ্যাতির তলায় এই সমস্যা ঢাকা পড়ে যায়।

অ্যামনেস্টির আন্তর্জাতিক নারী অধিকার সংক্রান্ত গবেষক অ্যানা ব্লাস ডিডাব্লিউকে বলেছেন.” ডেনমার্কের মানুষ মনে করতেন, সেখানে লিঙ্গ সাম্য প্রতিষ্ঠিত। এটাই ছিল পরিবর্তনের পক্ষে বড় বাধা। তারা লিঙ্গ-ভিত্তিক হিংসাকেও অবহেলা করত।”

ডেনমার্কের বিচার মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য জোগাড় করে অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, প্রতি বছর ডেনমার্কে ছয় হাজার ৭০০ জন নারীকে হয় ধর্ষণ করা হয় বা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। তবে ২০১৯ সালে ডেনমার্কের পুলিশের কাছে এক হাজার ১৭টি ধর্ষণের অভিয়োগ এসেছিল। তার মধ্যে ৭৯ জনের শাস্তি হয়েছে।

অ্যানা জানিয়েছেন, অনেক মেয়েই তাঁকে বলেছেন, যেহেতু আইন অনুসারে শাস্তি হয় না, তাই তাঁরাও ওই ধরনের ঘটনাকে ধর্ষণ বলে মনে করেন না। এখন আইন পরিবর্তনের ফলে অনেকে এগিয়ে এসে অভিযোগ জানাবেন। নিয়মের এই পরিবর্তনের কথা এবং অনুমতি ছাড়া জোর করে যৌন সংসর্গ মানে যে ধর্ষণ, সেটা যৌন শিক্ষার পাঠক্রমেও ঢোকানো দরকার।

সম্মতির সংস্কৃতি

ইউরোপ জুড়েই মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসা একটা বড় সমস্যা। ইইউ-র তথ্য বলছে, প্রতি তিনজন মেয়ের মধ্যে একজনকে শারীরিক নিগ্রহ বা যৌন হিংসার মুখে পড়তে হয়। করোনার পরে মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসা বেড়েছে।

আইন সংশোধনের পর ডেনমার্ক হলো ইইউ-র ১২ তম দেশ, যেখানে সম্মতি ছাড়া যৌন মিলনকে ধর্ষণ বলা হয়। জার্মানি, যুক্তরাজ্য, সুইডেনে এই নিয়ম আগে থেকেই চালু রয়েছে। স্পেন ও নেদারল্যান্ডও আইন পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেছে।

ইস্তানবুল কনভেশনে মেয়েদের বিরুদ্ধে গার্হস্থ সহ সব ধরনের হিংসা বন্ধ করার কর্মসূচি নিতে রাজি হয় সবকটি ইইউ দেশ। তাই এখন আইনে এই পরিবর্তন হচ্ছে। তবে অধিকাংশ দেশে এখনো নতুন আইন চালু হয়নি।

কিছু দেশ আইন পরিবর্তন করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেনমার্কের মতো দেশে আইন পরিবর্তনের সুফল মেয়েরা পাবেন। ধর্ষণ নিয়ে সমাজের মনোভাবও বদলাবে।

অ্যানা ব্লাসের দাবি, এই আইন কীভাবে সমাজে এবং আইন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে, মানুষকে সজাগ করে, তথাকথিত রেপ কালচার থেকে মানুষ সরে আসে, সম্মতির সংস্কৃতি চালু হয় সেটা দেখা দরকার। সকলের স্বার্থেই এটা হওয়া দরকার।

ক্রিস্টিনের জন্য আইন পরিবর্তন আর কাজে লাগবে না। দেরি হয়ে গেছে। ক্রিস্টিন বলেছেন, ‘এটা দুঃখের যে আমি এই আইনের সাহায্য পেলাম না। কিন্তু আমি আশ্বস্ত যে, আমার সন্তানরা ভালো পরিবেশ পাবে। আমার মতো যন্ত্রণা ভোগ করতে হলে সুবিচার পাবে। এই আইন হলো আমার ছেলেমেয়েদের জন্য।’ সূত্র: ডয়েচে ভেলে।

আপনি আরও পড়তে পারেন