কচুরিপানা ব্যবহার জানলে ফেলনা নয়! চলুন জেনে নিই।

মাহফুজ হাসান,কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি :
নিবিড় জলে ফুটে থাকি ভাসি ভাঙ্গা জলে,
কচুরি ফুল বলে নেয়না কেহ কূলে।
গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি জলজ বহুবর্ষজীবি উদ্ভিদ এই কচুরিপানা ও তার ফুল! এ যেন প্রকৃতির আপন খেয়ালে বেড়ে ওঠা এক অবহেলিত শোভা।
কিশোরগঞ্জের  হোসেনপুরের প্রায় প্রত্যেক এলাকায় ছোট বড় খাল, বিল, ঝিল ও বাড়ির পাশের ডোবায় দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন কচুরিপানা ফুল। বৃহৎ ব্রম্মপুত্র নদেও মনানন্দে ভাসতে দেখা যায় দলবদ্ধ কচুরিপানা।
বিকশিত শিরে ফুটে থাকা ফুল যেন প্রকৃতি প্রেমিদের হাতছানি দিচ্ছে, তার সৌন্দর্যের পশরা গায়ে মাখতে।
এই ফুলের গভীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেকেই কচুরিপানা দেখতে বিভিন্ন জলাশয়ে যান। অনেকেই আবার কচুরিপানার ফুল নিয়ে শৈশবে করা খুনসুটির কথা ভেবে নস্টালজিক হয়ে পড়েন। বিকেলে বিলের ধারে কচুরিপানাকে একত্রিত করে একটির উপর কয়েকটি রেখে সাঁকো তৈরি করে এপার থেকে ওপারে যাওয়ার স্মৃতিতে এখনো অনেকে ভেসে যান।
তাই নীলচে শিরা-উপশিরায় বিন্যস্ত হালকা বেগুনি রঙের মায়াবী এই ফুল হারানো শৈশবকে খুব কাছে টানে। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের সিদলা ইউনিয়নের  নতুন সরক মোড় থেকে চরাঞ্চলের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম হঠাৎ চোখ আটকে যায় মনোলোভা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, কচুরিপানার ফুল মাথার চুলে গুঁজে দিয়ে খেলা করছেন প্রাথমিক পড়ুয়া মেয়েরা।মনে হচ্ছিল পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য যেন তারা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন।উপজেলার গ্রামাঞ্চলে  গেলে দেখা যায়, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা জলাশয় থেকে কচুরিপানার ফুল উঠিয়ে খেলা করে। মেয়েরা খোপায় বাঁধে। পড়ন্ত বিকেলে জলাশয়ের ধারের পাশের রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে এমন দৃশ্য হরহামেশা দেখা যায়।
কচুরিপানা দেখতে গাঢ় সবুজ হলেও এর ফুলগুলো দেখলে মনে হবে গাঢ় সবুজের মাঠে শুভ্র আলোয় জ্বলছে অযুত-নিযুত তারা। ফুলগুলো সাদা বা হালকা আকাশি রঙের পাপড়ির মধ্যে বেগুনি ছোপযুক্ত এবং মাঝখানে হলুদ ফোঁটা বিদ্যমান। পুরোপুরি ফুল ফোটার আগে এগুলোকে দেখতে অনেকটা নলাকার দেখায়।
পাপড়িগুলোর মাঝখানে পুংকেশর দেখতে পাওয়া যায়। একটি ফুল থেকে ৯ থেকে ১৫টি আকর্ষণীয় পাপড়ির ফুলের থোকা বের হয়। প্রায় সারা বছরই ফুল ফুটতে দেখা যায়। কচুরিপানা খুব দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে। এটি প্রচুর পরিমাণে বীজ তৈরি করতে পারে। এমনকি ৩০ বছর পরও অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারে।
 তথ্যমতে, অর্কিড সাদৃশ্য ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের পর্যটক স্কনক ১৮ শ’ শতাব্দীতে বাংলায় নিয়ে আসেন কচুরিপানা।
কচুরিপানার ফুল, পাতা, শিকড়সহ অন্যান্য অঙ্গের নানাবিধ ব্যবহার আছে। পানি পরিশুদ্ধিকরণে এই জলজ উদ্ভিদ ব্যবহার করা যায়। এশিয়া মহাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলের খাবারের মেন্যু দখল করে রয়েছে কচুরিপানা। এটি সেদ্ধ করে নানা পদে রান্না করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে কচুরিপানাকে অনেকে ভাসমান সবজি চাষ, মাছের খাবার, জৈব সার, গবাদি পশুর খাবার, রাস্তার গর্ত ভরাট করা, পিচ ঢালাইয়ের নতুন রাস্তায় পানি দেয়ার ও পিচ মজবুত করার জন্য, সিমেন্টের খুটি মজবুত করা ও পানি ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করে থাকেন।
জানা যায়,স্বাস্থ্য, ত্বক ও চুলের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান আছে এই কচুরিপানায়। যেমন- ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়, একজিমা সারায়, চুল পরিষ্কার, ঝলমলে ও কোমল ভাব আনে, দাঁত ও গলা ব্যথা কমাতে, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে, মাতৃদুগ্ধ বাড়াতে, অনিয়ন্ত্রিত ঋতুস্রাবের সমস্যা সমাধানে, ওজন নিয়ন্ত্রনে, রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে কচুরিপানা।
যারা এর ব্যবহার ও উপকারিতা জানেন, তাদের কাছে এটি একটি সম্পদ। আবার যারা এর ব্যবহার পদ্ধতি আয়ত্ব করতে পারেনি; তাদের কাছে এটি একটি আগাছা ও বিড়ম্বনার। তাই এই সম্পদটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে অনেক কৃষক উৎপাদন খরচ হ্রাস করতে পারবেন।
একসময় ভাবা হতো কচুরিপানা হলো ক্ষতিকর আগাছা। এ দেশের জল থেকে একে নির্মূলের চেষ্টা অতীতে কম হয়নি। কিন্তু সময় ও অর্থের অপচয় ছাড়া তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেসব বাদ দিয়ে একালে শুরু হয়েছে নতুন চেষ্টা— কচুরিপানার মধ্যে কী কী গুণ আছে খুঁজে বার করে কাজে লাগানোর চেষ্টা। এখন বোঝা যাচ্ছে, যাকে এতোদিন ক্ষতিকর আগাছা বলে ভাবা হতো সেই কচুরিপানার উপকারিতা কম নয়। এ পানার বহুমুখী ব্যবহার জানলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
কচুরিপানার বাড় অবিশ্বাস্য। অঙ্গজ জনন প্রক্রিয়ায় এই গাছ খুব তাড়াতাড়ি সংখ্যায় বাড়ে। অনুকূল পরিবেশে কচুরিপানা এক সপ্তাহের মধ্যে বেড়ে দুগুণ হতে পারে। এছাড়া এ গাছ বীজের দ্বারাও বংশবৃদ্ধি করে। এক একটা কচুরিপানা গাছ থেকে ৫০০০-এরও বেশি বীজ তৈরি হতে পারে। বীজগুলোর এমন গুণ যে এগুলো সহজে নষ্ট হয় না। দেখা গেছে ৩০ বছর পরেও কচুরিপানার বীজ থেকে অঙ্কুর বেরোতে পারে।
কচুরিপানার বহুমুখী ব্যবহার
জৈব সার উৎপাদনে কচুরিপানা:কচুরিপানার একটা গুণ হলো, এই পানা জল থেকে নানান ধাতব লবণ ও অধাতব যৌগ শুষে নেয়। এই পানাকে কাজে লাগিয়ে জৈব সার তৈরি করলে তাতে পটাশিয়াম, ফসফরাস, নাইট্রোজেন, ইত্যাদি উপাদান বেশি মাত্রায় থাকে। ঐ সার হয় খুব উন্নত মানের। তাছাড়া কচুরিপানা পচে সার হতে সময় লাগে মাত্র দু মাস, অন্যান্য জৈব সারের থেকে বেশ কম। গ্রামবাংলায় এর জোগানও অপর্যাপ্ত। আজকাল কৃষিভিত্তিক এলাকাগুলোতে যেভাবে দিনদিন গোবরের লভ্যতা কমে আসছে তাতে আগামী দিনে কচুরিপানাই হয়ে উঠতে পারে জৈব সার উৎপাদনের মূল উৎস। এই পানা ব্যবহার করে লাভজনকভাবে জৈব গ্যাস তৈরি করাও সম্ভব।
ভাসমান কচুরিপানার বেডে সবজি চাষ:কচুরিপানার ভাসমানতার গুণ কাজে লাগিয়ে এর ওপরেই করা যায় সবজি চাষ। পদ্ধতি খুবই সহজ। বাঁশের সাহায্যে জলের ওপরেই ফ্রেম তৈরি করা হয়। তার মধ্যে কয়েকটা স্তরে কচুরিপানা গাদা করে জমিয়ে বেড বানানো হয়। গাদার পানা কয়েকদিনের মধ্যেই পচে যায়। কচুরিপানার এমনই উপকারিতা যে ঐ বেডে রাসায়নিক সার দেবার দরকারই হয় না। বেডের ওপরে কিছুটা মাটি ছড়িয়ে দিলেই যথেষ্ট।
সাধারণত এক একটা ভাসমান বেড শখানেক ফুট লম্বা ও পাঁচ-সাত ফুট চওড়া হয়। এই বেডে চাষ করা যায় প্রায় সব রকম শাক সবজি। যেমন—
লাল শাক,পুঁই শাক,কলমী শাক,ডাটা,মূলো,লাউ,
কুমড়ো, ইত্যাদি।কচুরিপানার গুণে ভাসমান চাষে সবজির ফলন যথেষ্ট ভালো হয়। চাষ কম খরচের ও লাভজনক।
পশুখাদ্য তৈরিতে কচুরিপানার ব্যবহার:কচুরিপানার পাতায় প্রচুর পুষ্টি গুণ থাকায় গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, শূকর ইত্যাদি পশুর খাবার হিসেবে কাজে লাগে; তাছাড়া মাছের খাবার হিসেবে ও হাঁস-মুরগীর খাবার হিসেবেও কচুরিপানা ব্যবহার করা সম্ভব। এমনিতে অক্সালেট কেলাস থাকায় শাকাহারী প্রাণীরা এই পানার কাঁচা পাতা খেতে ততোটা পছন্দ করে না। তবে কচুরিপানার পাতা কুচিয়ে গুড়, লবণ, ধানের কুড়ো, ভুট্টার কুড়ো, সয়াবিন গুঁড়ো ইত্যাদির সাথে মিশিয়ে উন্নত মানের পশুখাদ্য রূপে ব্যবহার করা যায়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে কচুরিপানাকে এ ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
জল শোধনে কচুরিপানার উপকারিতা:জল শোধনে কচুরিপানা বিশেষ উপকারিতার পরিচয় দেয়। যে সব জলাভূমিতে দূষিত জল এসে মেশে সেখানে দারুণ কাজে লাগে এই গাছ। কচুরিপানার মূল দূষিত জল থেকে ক্যাডমিয়াম, নিকেল, জিংক, সীসা, পারদ, ইত্যাদি ভারি ধাতু শোষণ করে নেয়। কচুরিপানার গুণে সেখানে মাছ চাষও সম্ভব হয়। গাছেদের ব্যবহার করে দূষিত জল শোধনের এই পদ্ধতিকে ইংরাজিতে বলা হয় ফাইটোরেমেডিয়েশন।
আসবাব তৈরিতে কচুরিপানা:কচুরিপানা থেকে তৈরি করা যায় সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র। এর জন্য জল থেকে তুলে কচুরিপানার ডাঁটিগুলো প্রথমে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। এরপর সেগুলো রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। সব শেষে শুকনো ডাঁটিগুলো থেকে ফিতে কেটে কাঠ বা স্টিলের ফ্রেমের ওপর জড়িয়ে সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র ও ঘর সাজানোর জিনিস তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
কচুরিপানার আসবাব
অনুসন্ধানে প্রতিয়মান হয়,এই আসবাবগুলো শুধু সুন্দরই হয় না, এগুলোর আরো একটা গুণ আছে। এগুলো থেকে এক ধরণের মৃদু সুবাস পাওয়া যায়। ইদানিংকালে কচুরিপানার আসবাব চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেক দেশে কচুরিপানার তন্তু বস্ত্র ও কাগজ শিল্পেও কাজে লাগে।

আপনি আরও পড়তে পারেন