সুদিপ্ত সালাম
অনেকদিন আগে থেকেই তেলের সাথে বিশ্বরাজনীতি ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে গেছে। বিশ্বরাজনীতির একটা বিরাট অংশ নিয়ন্ত্রণ করে পরিশোধিত বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল। যুগে যুগেই এই জ্বালানি তেল নিয়ে বেঁধেছে সংঘাত।
দ্য ইকোনমিস্টের একদল গবেষক তেল সম্পদকে নিয়ে বলেছেন ‘এই সম্পদরূপী অভিশাপ অর্থনীতিকে চাপে ফেলে, রাজনীতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ও যুদ্ধকে উসকে দেয়।’ বর্তমান বিশ্বে যত সংঘাত দেখা যাচ্ছে, যেমন; ভেনিজুয়েলা সংকট, ইরানের উপর মার্কিন অবরোধ, লিবিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধ, সিরিয়ার সংঘাত এগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তেলের বিষয় জড়িত।
একটা কমন বিষয় দেখা যায় যে, যেখানেই তেল সেখানেই আমেরিকার উপস্থিতি। এর মূল কারন হল আধুনিক সভ্যতার উৎকর্ষের পিছে মূল শক্তি হল জ্বালানি বা ফুয়েল। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান যুগটা ফসিল ফুয়েলের যুগ। এ যুগে যাদের কাছে তেল, গ্যাস, জ্বালানি আছে তারাই পারবে তাদের সভ্যতার উন্নতি করতে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হচ্ছে। আর বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক সভ্যতা পুরোপুরি অচল।
এর পাশাপাশি কারখানা চালানো, গাড়ি সব কিছুতেই জ্বালানি প্রয়োজন।
কিন্তু এখন পর্যন্ত জ্বালানি তেলের বিকল্প হিসেবে পরমানু ছাড়া আর তেমন কিছু আবিস্কার হয়নি।
এ অবস্হায় বাংলাদেশ হয়তো তার গ্যাস সম্পদের সদ্ব্যবহারের কথা ভাবতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে পর্যাপ্ত গ্যাসের খনি নেই। যা আছে তা আগামী ১০ বছর পর শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে। এরপর উপায় কি?
মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আমদানি করে এখন চাহিদা মেটানো হচ্ছে। কিন্তু ২০৭০ এর পর মধ্যপ্রাচ্যের তেল, গ্যাস ও শেষ হবার উপক্রম হবে বলে শঙ্কা রয়েছে। কিন্তু তেল, গ্যাসের চাহিদা বাড়ছেই।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল, গ্যাস রিজার্ভের দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের দেশের উৎপাদন সীমিত রেখেছে। হয়ত যতদিন অন্য দেশ থেকে নিয়ে চলা যায় সেই পলিসিই তারা ফলো করছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জ্বালানি ঘাটতির দেশ হবার ফলে আপাতত আমদানি করার বিকল্প নেই। আমাদের সমুদ্রে যে ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা আছে সেখানেও তেল, গ্যাস এখনো প্রমাণিত নয়। আর প্রমাণিত হলেও এখনি সেগুলা শেষ করে ফেললে ২০৫০ এর পর সম্পূর্ন জ্বালানি আমদানির উপর নির্ভর করে চলতে হবে। কিন্তু তখন যেহেতু তেলে গ্যাসের রিজার্ভ শেষের পথে থাকবে পুরো বিশ্বে তাই দাম ও হবে চড়া। সেই ধাক্কা বাংলাদেশ সামলাতে পারবে কিনা সেটাও আগে থেকে বলা কঠিন।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কয়লা। বিশ্বের অনেক দেশ কয়লা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে একারনেই। কিন্তু আমাদের হাতে অপশন কম। হয়ত বিশ্ব কয়লা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমরা হয়ত কয়লা আমদানি করে স্টাবল প্রাইসে বিদ্যুৎ পেতে পারি। হয়ত একারনেই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলি করা হচ্ছে। তবে আজ হোক অথবা ৫০ বছর পর, কয়লাও শেষ হয়ে যাবে। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের হাতে আপাতত অপশন নেই।
পরমানু বিদ্যুৎ বিগত অর্ধ শতক ধরে উন্নত বিশ্বে ব্যাবহার হচ্ছে। এই প্রযুক্তিতে এক্সেস অনুন্নত দেশগুলির ছিলনা এতদিন। ফ্রান্স তাদের মোট বিদ্যুৎ এর ৭০% পরমানু থেকেই পায়। সেই হিসাবে আমরা আপাতত এই প্রযুক্তিতে ভাগ বসাচ্ছি। দুইটি পরমানু প্রকল্পের মাধ্যমে। কিন্তু আর কি কি অপশন আমাদের হাতে আছে?
থোরিয়াম বেজড রিয়েক্টর নিয়ে গবেষনা চলছে। কিন্তু এখনো বাস্তবে আসেনি। আমাদেরকে এখনো ইউরেনিয়াম এর উপরেই নির্ভর করতে হবে। আর উন্নত প্রযুক্তি উন্নত দেশ গুলি ব্যবহার করলেও আমাদের পর্যন্ত আসতে অনেক দেরি। সেই ধাক্কা আমরা নিতে সক্ষম কিনা আমরা কি ভেবে দেখেছি?
অনেকেই বলবেন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ এর কথা। পানি বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ এর কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ছোট দেশ এবং ভাটির দেশ হবার কারনে এত জমি বাংলাদেশের নেই। এক কাপ্তাই লেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতেই আমরা ৭৮ বর্গমাইল এলাকা হারিয়েছি।
বায়ু বিদ্যুৎ এর জন্য পর্যাপ্ত জমি আমাদের নেই। আর বায়ু বিদ্যুৎ বায়ুর প্রবাহের উপর নির্ভর করে। বাতাসের প্রবাহ না থাকলে বিদ্যুৎ আসবে না। সারা বছর বাতাসের যথেষ্ট শক্তি সম্পন্ন প্রবাহ আছে এমন এলাকাও আমাদের দেশে সীমিত।
এই মুহুর্তে বাংলাদেশ যেটা করতে পারে সেটা হল উন্নত দেশের মত সমুদ্র নিয়ে গবেষনা। সমুদ্রের ঢেউ কে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু সেখানেও সমস্যা। বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের মত প্রযুক্তি এখনো আমাদের হাতে নেই। বিশ্বে এরকম কোন বড় উদাহরন ও নেই। সৌর বিদ্যুৎয়ের জন্যও একই সমস্যা। প্রচুর জায়গা দরকার। যেটা এত ছোট দেশে সম্ভব না। তাহলে উপায় কি?
সম্প্রতি কোরিয়া এবং আরো কিছু দেশ হাইড্রোজেন নিয়ে গবেষনা করছে। ভবিষ্যতের শক্তি চাহিদা তারা হাইড্রোজেন দিয়েই মেটাতে চায়। কিন্তু এত উন্নত প্রযুক্তি এত সহজে আমাদের পর্যন্ত পৌছানো সম্ভব না।
এখন যেটা হতে পারে সেটা হল পরমানু দিয়ে হয়তো আগামী কয়েকশ বছর সভ্যতা চলতে পারবে।
বাংলাদেশ আমেরিকার মত শক্তিশালী না যে অন্য দেশে ঘাটি গেড়ে সেখান থেকে তেল, গ্যাস নিয়ে আসবে। সরকারী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কোন বিকল্প আপাতত আমাদের নেই। জ্বালানি নিয়ে গবেষনা এখনি শুরু করতে হবে।
ভবিষ্যতে বিশ্ব পলিটিক্সে পানি এবং জ্বালানি এই দুটি নিয়ে অসংখ্য যুদ্ধ বাধবে সেটা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। আর এই পলিটিক্সে আমরা বেশ পিছিয়ে।
জ্বালানি নিয়ে গবেষনা এখন সময়ের দাবি।