খুলনা সিটি নির্বাচন | অপেক্ষা এখন ভোটের

খুলনা সিটি নির্বাচন | অপেক্ষা এখন ভোটের

প্রচারযুদ্ধ শেষ, শুরু হবে ভোটযুদ্ধ। এখন ভোট গ্রহণের পালা। আগামীর নগর পিতা নির্বাচনের জন্য আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলবে সেই ভোট গ্রহণ। ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ ভোটারই মনস্থির করে ফেলেছেন, কার হাতে তুলে দেবেন নিজের ওয়ার্ড ও খুলনা সিটি করপোরেশনের উন্নয়নের দায়িত্ব। আজ সোমবার ভোট গ্রহণের জন্য ব্যবহূত ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী পৌঁছানো হবে ভোটকেন্দ্রগুলোতে। সংশ্নিষ্ট প্রিসাইডিং অফিসাররা পুলিশি প্রহরায় নিয়ে যাবেন এসব সামগ্রী।

চাপা শঙ্কা : সপ্তাহব্যাপী পুলিশের টানা গ্রেফতার অভিযানকে কেন্দ্র করে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে চাপা শঙ্কা বিরাজ করছে খুলনার নানা মহলে। এ গ্রেফতারে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে বলে এরই মধ্যে মত দিয়েছেন স্থানীয় সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) কর্মকর্তারা। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে গতকালও পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে দুই দল। দুপুর সাড়ে ১২টায় দলীয় কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এস এম কামাল বলেন, ‘বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু থেকে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছেন। তার (মঞ্জু) নির্বাচনে কালো টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন একজন ব্যবসায়ী। বিভিন্ন বস্তিতে কালো টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনার চেষ্টা ও অপপ্রচার করছেন। সাধারণ ভোটারদের হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন তিনি।’

এর আগে সকাল সাড়ে ৮টায় নিজ বাড়িতে প্রেস ব্রিফিংয়ে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে এখনও শঙ্কামুক্ত হতে পারিনি। কারণ এক সপ্তাহ ধরে পুলিশ বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বাড়িতে তল্লাশির নামে অভিযান চালিয়েছে। এ পর্যন্ত দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার রাতেও বিএনপির ২ হাজার নেতাকর্মীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৮ জনকে আটক করা হয়েছে। নেতাকর্মীরা রাতে বাড়িতে না থাকায় গ্রেফতারের সংখ্যা কম। সরকার নির্বাচনকে ভোট ডাকাতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’

প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তীব্র :  নির্বাচনের শেষ সময়ে এসে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ভোটের হিসাব-নিকাশ। মেয়র পদে প্রার্থী ৫ জন হলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে। ভোটারদের ধারণা, মেয়র পদে এবার লড়াই হবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।

আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেকের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু। মঞ্জু ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও খুলনা-২ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে বিএনপির মহানগর কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক তিনি। সদালাপী হিসেবে নগরীতে পরিচিতি আছে তার। আর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক ৪ বার সংসদ সদস্য ও একবার মেয়র ছিলেন। তারও আগে কাউন্সিলর ছিলেন ১২ বছর। খারাপ লোকজনকে প্রশ্রয় দেন না বলে সুনাম রয়েছে তার। এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য মরিয়া খুলনার প্রভাবশালী এ দুই রাজনীতিক।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, ‘এবারের নির্বাচন অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থী দু’জনেই প্রভাবশালী রাজনীতিক। নগরীতে ২ জনেরই ভালো ইমেজ রয়েছে এবং তারা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে-ই জিতুক না কেন জিতবেন খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে।’

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক  বলেন, ‘প্রতিপক্ষকে আমি কখনোই দুর্বল ভাবি না। তবে আমাদের কর্মীদের মধ্যে এবার জেতার জন্য একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছে। আমার প্রতি তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সাড়া আছে।’

বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘মেয়র পদে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না। কারণ আওয়ামী লীগ ও তার প্রার্থী ইমেজ সংকটে আছেন। গতবার ৬০ হাজার ভোটে আওয়ামী লীগ হেরেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবার লাখো ভোটে হারবে ইনশাল্লাহ।’

সব ভোট ব্যাংকে শেষ মুহূর্তের যোগাযোগ : নতুন ভোটার, নারী, শ্রমিক ও সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোট ব্যাংকগুলোকে কাছে টানতে গতকাল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রার্থীরা গণসংযোগ করেছেন। ৫২ হাজার নতুন ভোটারকে পক্ষে টানার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী। খুলনার স্থানীয় বাসিন্দা ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ধারণা, খুলনা মহানগীতে সংখ্যালঘু, ‘নন খুলনা’ এবং ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোর ভোটার সংখ্যা মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। বলা হচ্ছে, এসব ভোটার যেদিকে ঝুঁকবেন, সেদিকেই যাবে নির্বাচনের ফল।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেসিসিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। এর মধ্যে নতুন ভোটার প্রায় ৫২ হাজার। বস্তিবাসী ভোটার রয়েছে ৫০ হাজার, হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটার প্রায় ৭০ হাজার, আটকে পড়া পাকিস্তানি ভোট ২০ হাজারেরও বেশি। এ ছাড়া খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে পাটকল শ্রমিক ভোটার আছেন প্রায় ৪০ হাজার। এদের একটি বড় অংশ খুলনার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা, কিন্তু ভোটার কেসিসি এলাকার।

এ ছাড়া খুলনার ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শ্রমিকদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন জেলা থেকে খুলনায় এসে বসবাস করছেন। তারাও কেসিসির ভোটার। এসব ভোটই জয়-পরাজয়ের নিয়ামক বলে মনে করছেন প্রার্থীরা।

এর বাইরেও নগরীর নতুনবাজার, গ্রিনল্যান্ড বস্তি, রেলওয়ে বস্তি, মুজগুন্নী বাস্তুহারা কলোনিসহ কয়েকটি এলাকা মিলে প্রায় ৬০ হাজার বস্তি ভোটার রয়েছেন। জয়-পরাজয়ের ব্যবধান গড়ে তুলতে পারেন শুধু বস্তির ভোটাররাও।

ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি সম্পন্ন :  খুলনা সিটি করপোরেশনের এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫ জন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক, বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু, জাতীয় পার্টির এস এম শফিকুর রহমান মুশফিক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. মুজ্জাম্মিল হক ও সিপিবির মিজানুর রহমান বাবু। ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন ও সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ৩৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) সোনালী সেন জানান, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি কেন্দ্রে ২৪ জন এবং সাধারণ কেন্দ্রে ২২ জন করে পুলিশ ও আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে ৩ হাজার ৪৩৭ জন পুলিশ, ৪ হাজার ৪৬ জন অঙ্গীভূত আনসার, ৮১৯ জন ব্যাটালিয়ন আনসার দায়িত্ব পালন করবেন। নগরীতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ৩০০ সদস্য, ১৬ প্লাটুন বিজিবি, পুলিশের ৭০টি মোবাইল টিম, ৮টি মোটরসাইকেল টিম ও ১১টি স্ট্রাইকিং টিম দায়িত্ব পালন করবে। দেড় হাজার পুলিশ মোতায়েন থাকবে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে। এ ছাড়া নগরীতে টহল দেবেন র‌্যাব সদস্যরা। সব মিলিয়ে নির্বাচনের দিন দায়িত্ব পালন করবেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় সাড়ে ৯ হাজার সদস্য।

রিটার্নিং অফিসার মো. ইউনুচ আলী জানান, নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হবে খুলনা বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে।

দুটি কেন্দ্রে ইভিএম :  নির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের সাহায্যে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য আজ ১৪ মে ইভিএমের সাহায্যে প্রতীকী ভোট প্রদানের আয়োজন করেছে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়।

যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা :  খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচন ২০১৮ উপলক্ষে খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আমিন উল আহসান কেসিসি এলাকায় কিছু যান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এতে বলা হয়, আজ ১৪ মে দিবাগত মধ্যরাত ১২টা থেকে ১৫ মে দিবাগত মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত ট্যাক্সিক্যাব, বেবিট্যাক্সি/অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো ইত্যাদি চলাচল করতে পারবে না। তাছাড়া ১৩ মে দিবাগত মধ্যরাত ১২টা থেকে ১৬ মে সকাল ৬টা পর্যন্ত সব ধরনের মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না।

বিভাগীয় সমন্বয় সভা :  সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের লক্ষ্যে গতকাল সকালে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে বিভাগীয় সমন্বয় কমিটির সভায় বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া এতে সভাপতিত্ব করেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, পানি, বিদ্যুৎ, অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা স্ট্যান্ডবাই থাকবেন। সাধারণ দোকানপাট বন্ধ রাখা হবে। তবে খাবার, ওষুধ ও ফলের দোকান খোলা থাকবে।

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য চিঠি : নির্বাচনের দিন ভোট গণনা ও ফল প্রকাশের সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ওজোপাডিকোকে চিঠি দিয়েছেন রিটার্নিং অফিসার। ফল ঘোষণার স্থানে নিরাপত্তা বাতি লাগানোর জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। সেখানে জেনারেটর বসানো হয়েছে ইতিমধ্যে।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment