২১ আগস্ট ট্রাজেডি মাদারীপুরের নিহত হয় ৪ জন ॥ ভয়াবহ স্মৃতি আহতদের তাড়িয়ে বেড়ায় ॥পঙ্গুত্ব নিয়ে কাটাচ্ছে দুঃসহ জীবন

 মোঃ ইব্রাহীম,রাজৈর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি ॥

আজ সেই ভয়াবহ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৪ বছর। যে দিনটির কথা স্মরণ করলে আতঙ্কে কেঁপে ওঠে আহতসহ নিহতের পরিবার ও সারা দেশের মানুষ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ অনুষ্ঠিত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় অন্যদের সাথে মাদারীপুরের ৪ জন নিহত হয়। একই ঘটনায় আহত হয় আরো কয়েকজন। তারা এখন পঙ্গুত্ব নিয়ে দুঃসহ জীবন-যাপন করছেন।দীর্ঘ ১৪ বছর পরও সে দিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজও আহতদের তাড়িয়ে বেড়ায়।আর নিহতদের পরিবারে এখনও শোকের গ্লানি মোছেনি। বর্বরোচিত এ গ্রেনেড হামলায় নিহত শ্রমিক নেতা নাসিরউদ্দিন ছিল আওয়ামীলীগের অন্ধ ভক্ত। তাই আওয়ামীলীগের মিছিল, মিটিং বা সমাবেশ হলে তাকে কেউ বেঁধে রাখতে পারতো না। মিছিল-মিটিং-এর আগে থাকতো, শ্লোগান দিত। শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে সেই প্রতিবাদী কণ্ঠ আর শোনা যাবে না।তার বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামারপোল গ্রামে। নাছিরউদ্দিন থাকতেন ঢাকার হাজারিবাগে। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। এক সময়ে হাজারীবাগের শ্রমিক লীগের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঢাকায় কখনও রিক্সা চালাতেন, কখনও নুর হোসেন নামের একজন সরকারী কর্মকর্তার দোকানে বসতেন।রাজনীতির জন্য যে জীবন উৎসর্গ করল। সেই নাসিরউদ্দিনের বৃদ্ধ মা-বাবা-স্ত্রী- সন্তানদের খবর কেউ রাখেনা। নাসিরের বড় ছেলে মাহাবুব হোসেন (২৩) জানান, বাবার উপার্জনেই চলতো সংসার। বাবার মৃত্যুর পর টাকার অভাবে আমাদের লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।কোন কোনদিন আধপেটা আবার কোনদিন খাবারই জোটেনি।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। এখন সেই টাকার লভ্যাংশ দিয়ে আমার মা, আমি আর আমার ভাই নাজমুলকে নিয়ে কোনরকম বেঁচে আছি। বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিহত জেলার রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামে যুবলীগ নেতা নিহত লিটন মুন্সি। লিটন মুন্সির মেয়ে মিথিলার বয়স এখন ১৮। পিতার মৃত্যুর ৩ বছর পর মার বিয়ে হয়েছে অন্যত্র। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার অনুদান, লিটনের মা ও মেয়ের মধ্যে ৫ লাখ করে বিতরণ করে দেয়া হয়। বাবার পক্ষ থেকে এটিই তার শেষ পাওনা। এদিকে লিটনের ছোট বোন ইসমত আরা জানান, বাবা, মা আর আমরা দু‘ভাই-বোন ছিলাম এ সংসারের সদস্য। বাবা-মা’র বয়স হয়ে গেছে। কোন কাজ করার ক্ষমতা নেই। যেটুকু জমি-জমা আছে, তার উৎপাদিত ফসলেই আমাদের সংসার চালিয়ে নিতে হয়।এ ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই আমাদের।২০১৩ সালে যখন চেক গ্রহণ করেন আমার মা,তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আপনার সন্তান গেছে, দু:খ করবেন না। আমরা আছি।এ বছরও প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বাবা ও মা দেখা করেছেন।হজ্জ্ব করার ব্যাপারে বাবা ও মাকে প্রধান মন্ত্রী আশ^াস দিয়েছেন। এ বছর লিটন মুন্সির কবরটি বাঁধানো হয়েছে। গ্রেনেড হামালায় নিহত অপর যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। তার বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর। সে বরিশালের মুলাদি নানা বাড়িতে বড় হয়েছে। এ কারণেই তার লাশ মুলাদিতেই দাফন করা হয়। কথা হয় সেন্টুর স্ত্রী আইরিন সুলতানার সাথে। তিনি এখন ঢাকার মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি করেন। এক মেয়ে আফসানা আহমেদ রীদিকে (১৩) নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তিনি বলেন, এমন দু:খজনক স্মৃতি কি ভোলা যায়, না মুছে যায়। মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় থাকি।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০লাখ টাকার অনুদান পেয়েছিলাম। সে সম্বল আর চাকরি থেকে যা পাই, তা দিয়েই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। গ্রেনেড হামলায় অন্যদের মধ্যে নিহত সুফিয়া বেগমের বাড়ি রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের নারায়নপুর গ্রামে।ওই দিন মহিলা আওয়ামীলীগ নেত্রী আইভি রহমানের সাথে প্রথম সারিতেই ছিলেন সুফিয়া বেগম। চঞ্চলা ও উদ্যমী এই সুফিয়া সপরিবারে ঢাকায় থাকতেন। নিহত হবার পর তাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। ঢাকার থাকার কারণে সুফিয়ার লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়নি। সুুফিয়া বেগমের ছোট ভাই বীরমুক্তি যোদ্ধা শেখ অলিউজ্জামান জানান, গ্রেনেড হামলার ১৪ বছরেও বিচার না হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ।গ্রেনেড হামলার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কালকিনি পৌরসভার বিভাগদি গ্রামের মোহাম্মদ আলী হাওলাদারের ছেলে হালান হাওলাদারের একটি পা গ্রেনেড হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাকে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছিলেন হালান। এখন সে ঢাকা ঘুরে ঘুরে মুরগির ব্যবসা করে। হালানের সাথে কথা হলে সে বলে, খোড়া পা নিয়ে কষ্ট হয় ঘুরে ঘুরে মুরগি বিক্রি করতে। তাছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে প্রচুর স্প্রিন্টার। জ্বালা-যন্ত্রণায় অসহ্য লাগে মাঝে মাঝে। সে কারণে তেমন আয়ও করতে পারি না। উন্নত চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। কালকিনি পৌর এলাকার চরঝাউতলা গ্রামের সাইদুল ২১ আগষ্ট ঢাকা পল্টন ময়দানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেট হামলার শিকার হয়ে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে অন্ধত্বের নিয়ে জীবন যাপন করছে। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছিল সে। প্রধানমন্ত্রীর অনুদান পেয়ে সে ডিশ ব্যবসা করতে নামে, কিন্তু এলাকার প্রভাবশালীদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে সে ব্যবসাও লাটে ওঠে। এ নিয়ে ইউএনও থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্বারস্থ হলেও সাইদুলের কথা কেউ কানে নেয় নি। ২০১৩ সাথে জীবনকে পরিবর্তন করবার জন্য বাড়ির জমি বিক্রি করে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে ওমান গিয়েছিল। পরিশ্রমের কাজ করতে না পারায় ৮ মাস পর তাকে ফিরে আসতে হয় বাংলাদেশে। সে জানায়, ৮ মাসে সে ৫০হাজার টাকাও উপার্জন করতে পারেনি। চোখ হারিয়ে এখন সে প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী হয়েও প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডের জন্য সাইদুল এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। কৃষ্ণনগর গ্রামের কবির হোসেনের ডানহাত স্প্রিন্টারের আঘাতে বাঁকা হয়ে গেছে। এখন সে উপজেলার পাশে কাঁচা তরকারির ব্যবসা করে। বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬। উপার্জন করে শুধু কবির। অনেকেই অনেক টাকা পেলেও কবির পেয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। শরীরে এখনও স্প্রিন্টার রয়ে গেছে। যার যন্ত্রণায় ঘুম আসে না। এদিকে গ্রেনেড হামলার ঘঁনায় মাদারীপুর সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের পশ্চিম রঘুরামপুর গ্রামের রামকৃষ্ণ মন্ডল সেদিন চোখ হারিয়ে এখন চলছেন সহধর্মিনীর কাজের উপর।তার স্ত্রী গোবর দিয়ে জ¦ালানী বানিয়ে বিক্রি করে ৬ সন্তানসহ সংসার চালান। চোখ হারানো রামকৃষ্ণ পায়নি সামান্য স্বীকৃতিটুকুও।হতদরিদ্র ও নিভৃত পল্লীর অক্ষরজ্ঞানহীন রামকৃষ্ণ ও তার পরিবার বুঝতে পারেনি যে ঘটনায় সে আহত হয়েছে তাতে সরকার সহায়তা দিচ্ছে বা দিবে। তাই তার আহত হওয়ার বিষয়ে আর কাউকে কিছু না বলায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহতদের তালিকায় তার নামটি তালিকাভূক্ত হয়নি আজো। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহতদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন মাদারীপুরের সর্বস্তরের জনগন।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment