ইউরোপের কথা বলে এবার লেবানন থেকে সিরিয়ায় পাচার

ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে এবার লেবানন থেকে অর্ধ শতাধিক লোক সিরিয়ায় পাচার করা হয়েছে। পাচারের আগে তাদের প্রত্যেককেই ইউরোপে নিয়ে গিয়ে কাজ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পাচারকারী চক্র তাদের সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তে এনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। সিরিয়ার আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পাঠিয়ে দেয় সিরিয়ার কারাগারে। সেখান থেকে এরইমধ্যে ২৯ জনকে উদ্ধার করে দেশে পাঠানো হলেও আরও কয়েকজন এখনও কারাগারে রয়েছেন। তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাস।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়,এ বছরের এপ্রিল মাসে লেবানন প্রবাসী এক নারী কর্মী তার মেয়েসহ আরও কয়েকজনকে সিরিয়ায় পাচার করার অভিযোগ করেন লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাসে। তারই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস সিরিয়ায় অবস্থিত  বাংলাদেশ অনারারি কনসাল এবং জর্ডানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানায়। পরবর্তীতে সিরিয়ার অনারারি কনসাল প্রায় এক মাস পর  ১২ জনের খোঁজ পেয়ে বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানায়। এই ১২ জনের পরিবারের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে লেবাননের বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস জানতে পারে সিরিয়ায় অন্তত অর্ধশতাধিক বাংলাদেশি নাগরিককে ইউরোপে যাওয়ার কথা বলে সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তারা সেখানে আটক আছেন। তারপরই তারা দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়ে ২৯ জনকে সিরিয়া থেকে দেশে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন।

সিরিয়া থেকে ফিরে আসা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাদ্দাম হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, লেবানন প্রবাসী নুরু মিয়া দুই হাজার ৬০০ ডলারের বিনিময়ে কোনও প্রকার ঝুঁকি ছাড়াই ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার গ্যারান্টি দেয়। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়শ’ ডলার বেতনে কাজের সুযোগ আছে বলেও জানায়। লেবাননে কাজ করে মাসে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার বেশি রোজগার করা যায় না। বাড়ি ভাড়া, খাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে আর তেমন কিছুই হাতে থাকে না। তাই তার মুখে কথা শুনে রাজি হয়ে যাই। কিন্তু তারা ইউরোপ নেওয়ার কথা বলে সিরিয়া সীমান্তে নিয়ে গিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সিরিয়ার পুলিশ আমাদের জেলে ঢুকিয়ে দেয়।

সিরিয়া থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লেবানন প্রবাসী দালাল শুক্কুর আলী, নুরু মিয়া এবং তুরস্ক প্রবাসী দালাল আবু হানিফের মাধ্যমে  তারা লেবানন থেকে ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মানবপাচারকারী এই চক্রের সঙ্গে তুরস্ক, লেবানন এবং সিরিয়ায় অবস্থানরত আরও কয়েকজন বাংলাদেশির সম্পৃক্ততা রয়েছে। সিরিয়ায় পাচারের জন্য মূলত টার্গেট করা হয় নারী এবং শিশুদের। কারণ, নারী এবং শিশুদের সেদেশে অনৈতিক কাজে ও জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা হয়। ইরাকি শরণার্থীদের সিরিয়াতে এসব কাজেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মানবপাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে সিরিয়াকে ব্যবহার করে পাচারকারীরা। এখান থেকে স্পেন কিংবা গ্রিস দিয়ে প্রবেশ করা যায় ইউরোপে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া তথ্যমতে সিরিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ আশ্রয় প্রার্থীর আবেদন পাওয়ার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।

ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাতটি রুট রয়েছে। এই রুটগুলো ব্যবহার করা হয় লিবিয়া কিংবা তুরস্ক থেকে ইউরোপ প্রবেশের জন্য। এই সাতটি রুটের মধ্যে প্রতিদিন ব্যবহৃত হচ্ছে কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরের রুট। এই পথ ব্যবহার করে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য নিরাপদ মনে করে অভিবাসীরা। তাই দালালের কথায় প্রভাবিত হয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তারা চলে যান লিবিয়া কিংবা তুরস্ক। সেখান থেকে শুরু হয় ইউরোপ যাওয়ার মূল পর্ব। সেই সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে লেবানন। এখান থেকে সিরিয়া হয়ে ইউরোপে মানবপাচার চলছে। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিপুলসংখ্যক সিরীয় ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমাতে শুরু করে। এই সুযোগে দালালচক্র ইউরোপে পাঠানোর নাম করে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশিকে সিরিয়ায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাদের কেউ কেউ ইউরোপে পাড়ি জমাতে সক্ষম হলেও বেশিরভাগই সিরিয়ায় আটকা পড়ছে।

এদিকে বৈরুতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা পাচার হয়ে যাচ্ছে, তাদের আমরা সবসময় বলি যে, আপনারা যাওয়ার আগে আমাদের সরকারের যে বিধি নিষেধ ও নিয়ম কানুন রয়েছে সেগুলো অনুসরণ করে যাবেন। যারা সেসব নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে না যান, তারাই বেশিরভাগ পাচারের শিকার হন। আমাদের রাষ্ট্রদূতরা সেসব সমস্যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছেন। আমরা যেটা করি, সেটা হচ্ছে এমন কিছু শুনলে আমরা পাচারকারীদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করি।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment