পাটপাতার চায়ের কদর বাড়ছে ইউরোপে

পাটপাতার চায়ের কদর বাড়ছে ইউরোপে

পাটপাতা, অর্থাৎ পাটশাক বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। কিন্তু পাটপাতার চা গ্রামগঞ্জ বা শহরে এখনও জনপ্রিয় হয়নি। তবে পাটপাতার চা ঔষধি গুণসম্পন্ন এক ধরনের পানীয়। অতিরিক্ত চিনি নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষতিকর চিনি থেকে সুরক্ষা দেয় এই চা। দেশে এই চায়ের প্রচার-প্রসার এখনও অনেকের অজানা। তবে স্বাস্থ্য সচেতন ইউরোপীয়দের কাছে বাংলাদেশের ক্ষেত-খামারের এই পাটপাতার চায়ের উচ্চ কদর রয়েছে। বিশেষ করে বিলাসী জার্মানদের দিন শুরু হয় বাংলাদেশের এই চা পানের মাধ্যমে। সম্প্রতি জার্মানিতে গিয়ে বিষয়টি বিশেষভাবে নজরে আসে এই প্রতিবেদকের।

পাটকাঠি এখন আর শুধু জ্বালানিতেই সীমাবদ্ধ নেই। এই কাঠি দিয়ে উৎপাদিত চারকোল প্রসাধনী এবং কালি উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে রফতানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। পাটের আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের বিষয়টি সবারই জানা। পাটের আঁশে তৈরি হতে পারে মিহি ও উন্নতমানের সুতা। প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক উৎপাদনে তুলানির্ভর আমদানির পরিবর্তে পাটের সুতা ব্যবহার করা গেলে বিশ্ববাজারে পোশাক খাতের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়বে বহুগুণ। সাশ্রয় হবে অন্তত আট হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সোনালি আঁশ আর রূপালি কাঠির বহুমুখী বাণিজ্যে অর্থকরী ফসল হিসেবে দেশকে এগিয়ে নিতে পারে পাট।

তিন বছর আগে ৬ মার্চ পাটের আইন বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবছর ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা দেন। সে হিসেবে আজ বুধবার দেশে তৃতীয়বারের মতো দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সংশ্নিষ্টদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ এবং পাটমেলা উদ্বোধন করবেন। রাজধানীসহ দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহরে পাটচাষিসহ সংশ্নিষ্টদের নিয়ে বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও আলোকসজ্জা করা হচ্ছে। বিদেশেও বাংলাদেশ মিশনে পাটপণ্যের প্রদর্শনী হচ্ছে। অর্থনীতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের সম্ভাবনা বিকাশের লক্ষ্যে পাটচাষি, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, কর্মকর্তাসহ সংশ্নিষ্টদের কার্যক্রমের সমন্বয় বাড়ানোই দিবসটি উদযাপনের উদ্দেশ্য।

স্বাধীনতার পর দেশে পাট ছিল প্রধান অর্থকরী ফসল। নানা কারণে সোনালি আঁশের গৌরব হারিয়ে গেছে। হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে পাটের বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার বাড়ছে। অত্যাধুনিক জেট বিমান থেকে সাধারণ খেলনাসহ প্র্রায় সব পণ্যেই এখন কোনো না কোনোভাবে পাটের ব্যবহার হচ্ছে। অন্তত এক হাজার বহুমুখী পণ্য তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। প্রচলিত ব্যবহারের পাশাপাশি বহুমুখী ব্যবহারের ফলে পুনরুদ্ধার হচ্ছে রফতানি বাজার। আবাদ, উৎপাদন ও দর বেড়েছে পাটের। বাংলাদেশের ইতিহাসে গেল মৌসুমে মণপ্রতি সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে কাঁচা পাট। সঙ্গে পাটকাঠির মূল্য সংযোজনের ফলে মণপ্রতি দর দাঁড়ায় চার হাজার টাকা। সবচেয়ে বড় কথা, পাটপণ্য পরিবেশবান্ধব।

বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমসি) নতুন চেয়ারম্যান শাহ মুহাম্মদ নাসিম সমকালকে বলেন, পাটের আঁশ থেকে তৈরি পোশাকের উচ্চ মূল্যের (হাইয়ার ইন্ড) সাটিন-শুটিং উৎপাদন উপযোগী সুতা তৈরির পাইলটিং চলছে। এরই মধ্যে ডেনিম উৎপাদনে দেশি পাটকে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া আগে থেকেই সুতামিশ্রিত কাপড় তৈরিসহ অন্যান্য কাপড় উৎপাদনে পাট কাজে লাগানো হচ্ছে।

পাটের সুতায় রফতানিমুখী তৈরি পোশাক উৎপাদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, পাট গোটা অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। স্থানীয়ভাবেই মানসম্পন্ন সুতা পাওয়া গেলে তৈরি পোশাকের রফতানি সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাবে। দিন দিন সুতা-কাপড় সংগ্রহ করার সুবিধায় লিড টাইম (ক্রেতার কাছ থেকে রফতানি আদেশ পাওয়ার পর পণ্য পৌঁছানোর সময়) কমে আসবে। দরও হবে আমদানি করা সুতা কাপড়ের অর্ধেকেরও কম। ফলে উৎপাদন ব্যয় কমলে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়বে তৈরি পোশাক খাতের। পাটের সুতায় বিশ্বমানের উচ্চমূল্যের পোশাক উৎপাদনের অপেক্ষায় আছেন উদ্যোক্তারা। এ জন্য হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

রফতানি বাজার বাড়ছে :১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাটের অবদান। বছর বছর কমে এ হার এখন ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে আবার পুনরুদ্ধার হচ্ছে পাটের রফতানি বাজার। এখন প্রায় ১৫৫ দেশে বাংলাদেশের পাটপণ্য রফতানি হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের পাট বাণিজ্য এখনও অনেকটাই ভারতনির্ভর। গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের পাটপণ্যে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক্কারোপের কারণে রফতানি আয়ে প্রভাব পড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে রফতানি কম হয়েছে আগের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ। মোট ৬৬ কোটি ডলারের পাট ও পাটপণ্য রফতানি হয়েছে। তবে পাট গবেষণা এবং উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পাটশালার প্রধান নির্বাহী চাষী মামুন সমকালকে বলেন, রফতানির এই তথ্যের বাইরে হস্তশিল্প হিসেবেও অনেক পাটপণ্য রফতানি হচ্ছে। সেসব বিবেচনায় নিলে পাটের প্রকৃত রফতানি আয় আরও অনেক বেশি। বিশ্ববাজারে বছরে শুধু শপিংব্যাগের চাহিদা ৫০ হাজার কোটি পিস। বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট নিয়ে এর বড় একটি অংশের জোগান দেয় ভারত। রফতানি বাজারে জায়গা করা কোনো কঠিন কাজ নয় বাংলাদেশের জন্য।

জানতে চাইলে বহুমুখী পাটপণ্যের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের কিছু ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু পণ্য বাজারজাতের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাটশিল্পের উন্নয়ন পণ্য বহুমুখীকরণের কোনো বিকল্প নেই। পাটের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নির্ভর করছে পাটের বহুমুখীকরণের বাণিজ্যিক সফলতার ওপর।

পাটের উন্নয়নে পদক্ষেপ :পাটের উন্নয়নে সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- বহুমুখী পাটজাত পণ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা। পাটজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকে কৃষির মর্যাদা দেওয়া। পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইনে পণ্যের সংখ্যা ১৯টিতে উন্নীত করা। ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি- এই ছয়টি পণ্যের সঙ্গে নতুন করে মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, ময়দা, আটা, তুষ-কুঁড়া, পোলট্রি ফিড- এই ১১টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব পণ্য সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিক্রিতে পাটের মোড়ক ব্যবহারে বাধ্য করতে র‌্যাব-পুলিশের সহায়তায় পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি পাটকলগুলোর আধুনিকায়নের জন্য চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান সিটিইএক্সআইসির কারিগরি সহায়তায় সরকারি ২৬টি কারখানার আধুনিকায়নের কাজ চলছে। পাটকলগুলোতে জরিপ চালিয়ে সমস্যা চিহ্নিত করে আধুনিক ও উন্নতমানের বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে সক্ষম করে তোলা হবে। এতে যে পরিমাণ অর্থই লাগুক, তা দেবে চীন। বাজার বহুমুখী করার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করা হয়েছে। এ রকম বেশ কিছু উদ্যোগ আছে সরকারের।

তবে এসব পদক্ষেপ চলছে ঢিমেতালে। বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বিজেএমএর সচিব আবদুল বারেক খান সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা সত্ত্বেও পাটপণ্যকে এখনও কৃষিপণ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। ২ শতাংশ সুদে পাট উন্নয়ন তহবিল দীর্ঘদিনেও হয়নি। ১৯টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের আইনটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় কোটি কোটি টাকার ব্যাগ পড়ে আছে মিলের গুদামে। চাহিদা না থাকায় উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে বেসরকারি মিলগুলো। পাটপণ্যের নূ্যনতম মূল্য নির্ধারণ না করায় বাজারে চলছে অসম প্রতিযোগিতা।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment