১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার

১৯৭১-এ যখন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে নামল ভারত, তখন ইসরায়েল আর ভারতের মধ্যে কোনও রকম রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল না।উল্টো দিকে ইসরায়েলের সবথেকে কাছের মিত্র রাষ্ট্র আমেরিকা সাহায্য করছিল পাকিস্তানকে। আমেরিকার সাংবাদিক গ্যারি জে বাস যুদ্ধের অনেক পরে দিল্লির নেহরু লাইব্রেরীতে রাখা ‘হকসার পেপার্স’ নামে পরিচিত নথি ঘাঁটতে গিয়ে উদ্ধার করেন তখনও পর্যন্ত না জানা কিছু তথ্য।

মি. বাস পরে নিজের বই ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’-এ লিখেছেন, “ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার গোপনে কিছু অস্ত্র আর মর্টার পাঠিয়েছিলেন ভারতের কাছে। ইসরায়েলী অস্ত্র বিক্রেতা শ্লোমো জবলুদোউইক্সের মাধ্যমে গোটা প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হয়েছিল। ওই অস্ত্র সম্ভারের সঙ্গে ইসরায়েলের কিছু অস্ত্র প্রশিক্ষকও ভারতে এসেছিলেন সেই সময়ে। ইন্দিরা গান্ধীর প্রধান সচিব পি এন হাকসার আরও অস্ত্র পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন। গোল্ডা মেয়ার তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে ওই সাহায্য জারি থাকবে।”

“ইসরায়েল এরকম একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল যে ওই অস্ত্র সহায়তার পরিবর্তে ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন করুক। সেই অনুরোধ অবশ্য ভারত বিনম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এটা পছন্দ করবে না – এমনটাই কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছিল,” নিজের বইতে লিখেছেন মি. গ্যারি জে বাস। সেই ঘটনার প্রায় কুড়ি বছর পরে যখন নরসিমহা রাও ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তখন ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক তৈরী হয় ভারতের।

গোল্ডা মেয়ারকে বলা হত ইসরায়েলের দাদিমা। পুরনো আমলের যেরকম স্কার্ট আর কোট পরতেন নারীরা, গোল্ডা মেয়ারেরও পছন্দ ছিল সেরকমটাই।সবসময়ে কালো জুতো পরতেন তিনি। আর সঙ্গে থাকত পুরনো একটা হ্যান্ড ব্যাগ। ‘চেইন স্মোকার’ ছিলেন গোল্ডা মেয়ার। ফিল্টার ছাড়া সিগারেট খেতেন একের পর এক। রান্নাঘরে চা পান করতে করতে মানুষের সঙ্গে দেখা করতেন। চা-টাও নিজে হাতে বানাতেই পছন্দ করতেন তিনি। তবে হাতে কখনও লেডিজ ঘড়ি পড়তেন না – সবসময়ে পুরুষদের ঘড়িই দেখা যেত কব্জিতে। ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুড়িয়োঁ মন্তব্য করতেন গোল্ডা মেয়ার তাঁর মন্ত্রীসভায় একমাত্র ‘পুরুষ’। অন্য নারীদের হয়তো এরকম একটা কমপ্লিমেন্ট শুনতে ভালই লাগত, তবে গোল্ডা মেয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই কথাটা শুনলেই দাঁতে দাঁত পিষতেন। তিনি সবসময়ে বিশ্বাস করতেন যে কোনও কাজের ব্যাপারে সে নারী না পুরুষ এটা কখনই বিবেচ্য হতে পারে না।

গোল্ডা মেয়ারের জন্ম হয়েছিল ১৮৯৮ সালে, ৩ মে। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা পত্রে যাঁরা সই করেছিলেন, গোল্ডা মেয়ার ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৯৫৬ সালে ইসরায়েলের বিদেশ মন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। তবে ১৯৬৫ তে সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তবে বছর চারেক পরে ৬৯ সালে ইসরায়েলের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী লেওয়াই এশ্কালের মৃত্যুর পরে তাঁকে রাজনৈতিক সন্ন্যাস থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রী করা হয়।

পরে, আত্মকথা ‘আর এন: দা মেমরীজ অফ রিচার্ড নিক্সন’-এ তিনি লিখেছিলেন, “আমার খুব ভালই মনে আছে যখন আমরা ওভাল অফিসের সোফায় বসেছিলাম আর ফটোগ্রাফার ছবি তুলতে এসেছিলেন, তখন গোল্ডা মেয়ার হেসে হেসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিলেন। যেই ফটোগ্রাফার ছবি তুলে বেরিয়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাঁ পায়ের ওপরে ডান পা-টা তুলে দিয়ে সিগারেট ধরালেন। বললেন, ‘তো মিস্টার প্রেসিডেন্ট, এবার বলুন ওই বিমানের ব্যাপারে আপনি কী ঠিক করলেন? আমাদের বিমানগুলোর খুব প্রয়োজন। গোল্ডা মেয়ারের ব্যবহার অনেকটা পুরুষোচিত ছিল। তিনি চাইতেন যে তাঁর সঙ্গে একজন পুরুষের মতোই যেন সবাই ব্যবহার করে।”

১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিক চলাকালীন গেমস ভিলেজের ভেতরে ঢুকে আরব উগ্রপন্থীরা এগারো জন ইসরায়েলী অলিম্পিয়ানকে হত্যা করে।গোল্ডা মেয়ার ইসরায়েলী গুপ্তচর বাহিনী ‘মোসাদ’-এর এজেন্টদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই হত্যাকান্ডের সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বার করতে। দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তেই থাকুক না কেন, ওই অলিম্পিয়ানদের হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে যেন মেরে দেওয়া হয়। এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রীথ অফ গড’। এ নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন সাইমন রীভস। বইটির নাম ‘ওয়ান ডে ইন সেপ্টেম্বর’।

সেখানে মি. রীভস লিখেছেন, “গোল্ডা মেয়ার নিজের কামরায় ডেকে পাঠালেন জেনারেল ওহারোন ইয়ারেভ আর যিভি যামিরকে। ওই বৈঠকে গোল্ডা মেয়ার ইহুদীদের ওপরে জার্মানীতে কী অত্যাচার হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ বললেন। তারপরে বললেন মিউনিখ অলিম্পিকে এগারোজন অলিম্পিয়ানের হত্যাকান্ড। হঠাৎই মেরুদন্ড সোজা করে ইয়ারেভ আর জামিরের চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট গলায় আদেশ দিলেন, ‘সেন্ড ফর্থ দা বয়েজ’ [তোমার ছেলেদের কাজে নামাও]। ইসরায়েলের ওপরে মিশর আর সিরিয়ার হামলার খবর ছিল তাঁর কাছে। ইসরায়েলের সবথেকে পবিত্র ইয়োম কীপ্পুরের দিনে, ১৯৭৩ সালে মিশর আর সিরিয়া হামলা চালায় ইসরায়েলের ওপরে। তবে এই হামলা যে হতে পারে, সেই আভাস পেয়েছিলেন গোল্ডা মেয়ার।

২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সকালে তেল আভিভের উত্তরে হর্জলিয়াতে মোসাদের একটি সেফ হাউসে নেমেছিল একটা ‘বেল ২০৬’ হেলিকপ্টার। সেটি ল্যান্ড করতেই ইসরায়েলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। কারণ রোজ রোজ তো আর জর্ডনের শাহ হুসেইন সীমানা পেরিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে আসেন না! সেদিন শাহ হুসেইন একটা গোপন খবর পৌঁছিয়ে দিতে এসেছিলেন গোল্ডা মেয়ারের কাছে।

গোল্ডা মেয়ারের জীবনীকার এলিনোর বার্কেট লিখছেন, “শাহ হুসেইনকে গোল্ডা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন মিশরকে ছাড়াই সিরিয়া কী একাই হামলা চালাবে? হুসেইন জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার ধারণা মিশর সিরিয়াকে সাহায্য করবে।’ যখন এই খবরটা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশো দায়ানকে বলা হল, তিনি বেশী গুরুত্ব দিতেই চান নি। বলেছিলেন, জর্ডনের সঙ্গে মিশরের এমন সম্পর্ক নয় যে তারা এরকম একটা হামলার কথা জানতে পারবে। তিনি গোল্ডাকে বলেছিলেন, ‘আমরা সিরিয়ার ওপরে নজর রাখব। চিন্তার কোনও কারণ নেই।”

সুয়েজ খালের দিকে এগোচ্ছে মিশরের সেনা

ইসরায়েলের গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ এটাও জেনে গিয়েছিল যে মিশরীয় বাহিনীর এক ডিভিশন সেনা সুয়েজ খালের দিকে এগোচ্ছে। মিশরীয় সেনাবাহিনীর এক লক্ষ ২০ হাজার রিজার্ভ ফোর্সকে কাজে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। এই খবর জেনেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশো দায়ান বলেছিলেন যে ওটা মিশরীয় বাহিনীর ‘রুটিন এক্সারসাইজ’। তারপরে যখন সত্যিই হামলা হল, তখন অনেকেই বলেছিলেন এই হামলা আটকাতে না পারাটা গোল্ডা মেয়ারের একটা বড় ব্যর্থতা। লন্ডনের কিংস কলেজের যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক ড. এরিক ব্র্যাগম্যান একসময়ে ইসরায়েল সেনাবাহিনীতেও কাজ করেছেন।

তিনি বলছেন, “গোল্ডা বিশ্বাস করতেন ইসরায়েল যদি কিছুটা সময় দেয়, অপেক্ষা করে, তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই আরব দেশগুলো মেনে নেবে যে সাইনাই আসলে ইসরায়েলেরই অংশ। গোলান হাইটস আর পশ্চিম তীরও যে ইসরায়েলেরই ভাগ, সেটাও তারা মেনে নেবে এমনটাই ধারণা ছিল গোল্ডা মেয়ারের।”

“আমার মতে গোল্ডার এই চিন্তাধারা ভুল ছিল। একজন নেতার থেকে আমি তো এটাই আশা করব যে তাঁর নজর এমন বিষয়গুলোর ওপরে পড়বে, যেগুলো আমার মতো সাধারণ মানুষের নজর এড়িয়ে যাবে। আমার মনে হয় ১৯৭১ সালে আরব দেশগুলোর প্রস্তাব মেনে নেওয়া উচিত ছিল গোল্ডা মেয়ারের। তাহলে হয়তো আর ইয়োম কীপ্পুরের যুদ্ধটাই হত না, যাতে ইসরায়েলকে ৩ হাজার সৈনিক নিহত হয়েছিলেন।”

ইয়োম কীপ্পুরের যুদ্ধ এবং গোল্ডা মেয়ারের পদত্যাগ

মিশর যে তাদের ওপরে হামলা চালাতে চলেছে, তা যুদ্ধের প্রায় ৬ ঘন্টা আগেই কায়রো থেকে এক গোপন সূত্রে জানতে পেরেছিল ইসরায়েল। কিন্তু ওই হামলার জবাব কীভাবে দেওয়া হবে, তা নিয়ে ইসরায়েলের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ ছিল।

গোল্ডা মেয়ার তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ’এ লিখেছিলেন, “ইসরায়েলের সেনাপ্রধান ডাডো প্রথমে মিশরের ওপরে বিমান হামলার পক্ষপাতী ছিলেন। ততক্ষণে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে বিমানবাহিনী দুপুরের মধ্যে হামলার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। তবে তার জন্য ওই মুহুর্তেই আমাকে বিমান হানার নির্দেশ দিতে হত। কিন্তু আমি আগেই মনস্থির করে ফেলেছিলাম। ডাডোকে বলেছিলাম আমি এর পক্ষপাতী নই। ভবিষ্যতে কী হবে, তা অনিশ্চিত। হতে পারে আমাদের বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু আমরা যদি প্রথমে হামলা চালাই, তাহলে কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না। যতই আমি মনেপ্রাণে হামলা করতে চাইছি, কিন্তু তোমাকে ‘না’ বলতে বাধ্য হচ্ছি।”

সেই কয়েকদিনের ঘটনাবলীর আরেকটা ছবি পাওয়া যায় এলিনোর বার্কেটের লেখা থেকে।

গোল্ডার আরেক জীবনীকার বার্কেট লিখেছেন, “মোশো দায়ান গোল্ডার দপ্তরে দৌড়তে দৌড়তে ঢুকলেন। বললেন, গোল্ডা, আমি ভুল করেছি। আমরা ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছি। আপনি চাইলে আমার পদত্যাগ গ্রহণ করুন। কিন্তু গোল্ডা পদত্যাগ নেন নি। কিন্তু যেই মুহুর্তে মোশো ঘরের বাইরে চলে গেলেন, গোল্ডা একটা হলে চলে যান। তাঁর সহযোগী লু কাডর দেখেছিলেন গোল্ডা কাঁদছেন।”

বার্কেট আরও লিখেছেন, “দায়ান আত্মসমর্পণের কথা ভাবছে। তুমি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে চলে যাও। আমি তাকে বলে দিচ্ছি সে তোমাকে কয়েকটা ওষুধের বড়ি দেবে। আরব দেশগুলোর হাতে আমি জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ার থেকে আত্মহত্যাই শ্রেয়।”

ইয়োম কীপ্পুরের যুদ্ধে শেষ অবধি ইসরায়েলই জিতেছিল। কিন্তু তার জন্য ৩ হাজার সৈনিককে প্রাণ দিতে হয়েছিল। গোল্ডা মেয়ার সময়ের আগেই পদত্যাগ করেন। হারেৎজ থেকে

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment