রূপ নিচ্ছে স্বপ্নের সেতু

মাওয়া চৌরাস্তা থেকে সোজাসুজি দক্ষিণে পদ্মার পাড় বরাবর রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল পর পর পাঁচটি কারখানা। নদীপারে প্রকল্প এলাকায় সর্বত্র নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া নজরদারি। প্রকল্প এলাকার প্রায় দুই কিলোমিটারের মধ্যে পদ্মার পাড় ঘেঁষেই পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে তৈরি হচ্ছে পাইল। পাশেই ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে সেতুর ওপরের কাঠামোর পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে চলছে প্রস্তুতি। নদীর ওপর জেটির পাশে নোঙর করেছে মংলা বন্দর থেকে আসা বার্জটি। সোমবার দুপুর ১২টায় মংলা বন্দর থেকে এই বার্জেই আনা হয়েছে মূল সেতুর স্টিলের কাঠামোর স্প্যান তৈরির মেম্বার ও জয়েন্ট। এগুলো একসঙ্গে যোগ করলেই সেতুর একেকটি স্প্যান আকার পাবে।

024416Bridge_kalerkantho_pic

স্প্যান হলো দুটি পিলারের মধ্যে গাড়ি চলাচলের কাঠামো। নোঙর করা বার্জে একের পর এক সাজানো আছে সেতুর তিন হাজার ৮৯২ টন ওজনের মেম্বার ও জয়েন্টগুলো। এগুলো দিয়ে একটি স্প্যান পুরোপুরি এবং আরেকটির ৭৫ শতাংশ কাঠামো তৈরি করা যাবে। স্প্যানগুলোর কাঠামোর বাকি অংশ মংলা থেকে আরো চারটি বার্জে করে মাওয়ার পথে রয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বার্জে রাখা জয়েন্ট ও মেম্বারগুলো লম্বা ট্রেইলরে করে পাশের ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। সকাল ১০টায় গিয়ে দেখা গেল, সেখানে বার্জ (ঢাকা-এম ৬৮৭০) থেকে মূল সেতু নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কম্পানি

লিমিটেডের ট্রেইলরে গানট্রি ক্রেনে করে তোলা হচ্ছে সেতুর কাঠামোর অংশগুলো। তারপর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট ইয়ার্ডে।

প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের বলেন, সেতুর প্রতিটি স্প্যান হবে ১৫০ মিটার দীর্ঘ। স্প্যানের ওপর কংক্রিটের তৈরি অংশে চলবে গাড়ি। জানা গেল, স্প্যান হবে সোনালি রঙের। আরো দুই দফা রং করা হবে একেকটি স্প্যানে। মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত পর পর ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। ডিসেম্বর থেকে এগুলো বসানো শুরু হবে। প্রকৌশলীরা জানান, যেভাবে কাজ চলছে তাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের আগেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।

সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দোতলা কাঠামোর পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। দেশের সবচেয়ে বড় সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ এ পর্যন্ত ৩৮ শতাংশ এগিয়েছে। তার মধ্যে মূল সেতুর কাজ হয়েছে ২৮ শতাংশ। নদীশাসনের কাজ হয়েছে ২৪ শতাংশ। মাওয়া সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য সুবিধা বিষয়ক কাজ ৯৮ শতাংশ, জাজিরা সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য সুবিধা বিষয়ক কাজ ৯৩ শতাংশ এগিয়েছে। প্রকল্পে ব্যয় হবে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। চার লেনের এই সেতু হবে দোতলা।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ল্যাব টেস্ট ও ওজন ধারণের সক্ষমতা (লোড টেস্ট) পরীক্ষার পর আগামী ডিসেম্বরে পিলারের ওপর স্প্যান স্থাপন করা শুরু হবে। প্রথম ধাপে স্প্যান বসানো হবে জাজিরা প্রান্তে। প্রতিটি স্প্যানের গড় ওজন দুই হাজার ৯০০ টন। সেতুর পিলার হবে ৪২টি। তার মধ্যে ৪০টি পিলারের ছয়টি করে পাইল থাকবে ২৪০টি। দুই প্রান্তে ১২টি করে ২৪টি পাইল থাকবে। মাওয়া প্রান্তে ৬ নম্বর পিলারে তিনটি, ৭ নম্বর পিলারে তিনটি, জাজিরা প্রান্তে ৩৪ থেকে ৪০ নম্বর পিলারে তিনটি করে ২১টি পাইলিং করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৯টি পিলারে পাইলিং হয়েছে। বড় আকারের ৪২টি পিলারের ওপর ভর করে দাঁড়াবে সেতু। ১৫০ মিটার পর পর বসবে একেকটি পিলার।

জানা গেছে, চীনের কারখানায় ২০ থেকে ৮০ মিলিমিটার পুরু স্টিলপ্লেট কেটে ওয়েল্ডিং করে প্রতিটি মেম্বার তৈরি করা হচ্ছে। এ ধরনের ১২৯টি মেম্বার দিয়ে তৈরি হবে একেকটি স্প্যান। প্রতিটি স্প্যানের ওজন হবে দুই হাজার ২০০ টন। তার ওপর কংক্রিটের ডেক হবে ৭০০ টন ওজনের। সব মিলে প্রতিটি স্প্যানের ওজন হবে দুই হাজার ৯০০ টন।

পাইলিংয়ে এগিয়ে যাওয়ায় চীন থেকে স্প্যানের অংশগুলোও আসতে শুরু করেছে। মূল সেতুর প্রকৌশলীরা চীনের কারখানায় কী হারে অংশগুলো কিভাবে তৈরি হচ্ছে তা ই-মেইলে নিয়মিত জানতে পারছেন। দুই মাস আগেও প্রকল্পের চারজন প্রকৌশলী চীনের কারখানায় গিয়ে স্প্যানের বিভিন্ন অংশ তৈরির কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। চায়না রেলওয়ে সানহাইগুয়ান ব্রিজ গ্রুপ কম্পানি লিমিটেডের (সিআরএসবিজি) অধীনে চীনের সিনহোয়াংদাওয়ের কারখানায় এগুলো তৈরি হচ্ছে। কারখানার অদূরে সিনহোয়ান বন্দর থেকে জাহাজে করে মংলা বন্দর হয়ে পরে বার্জে করে চাঁদপুর হয়ে মাওয়ায় আসছে এগুলো। সিনহোয়াংদাও বন্দরে আরো একটি স্প্যানের কাঠামোর বিভিন্ন অংশ গত ২ আগস্ট জাহাজে তোলা হয়েছে। ১৬ আগস্ট সেই চালান মংলা বন্দরে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মূল সেতু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীরা জানান, চীনের রাজধানী পেইচিং থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরের ওই কারখানায় সংশ্লিষ্ট কম্পানির প্রোগ্রাম ম্যানেজার লসি লি প্রতিদিনই সেখানকার কাজের অগ্রগতি জানাচ্ছেন বাংলাদেশ সেতু বিভাগের প্রকৌশলীদের।

ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মাওয়া চৌরাস্তায় যাওয়ার আগেই চোখে পড়ে নিখুঁত নির্মাণের উদাহরণ হিসেবে মাওয়া সংযোগ সড়কের ঔজ্জ্বল্য। সকাল ও দুপুরে মাওয়া সার্ভিস এরিয়া থেকে মাওয়া চৌরাস্তা যাওয়ার পথে দেখা গেছে, ঢালাইয়ের কাজ চলছে মেশিনে। দুটি রোলার দিয়ে সমান করা হচ্ছে পিচের স্তর। দুপুরে সেখানে কর্মরত সার্ভেয়ার আবুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের আগেই সংযোগ সড়ক নির্মাণের সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। এখন সবচেয়ে ওপরের স্তর ওয়ারিং কোর্সের কাজ চলছে। দূর থেকেই চোখ কাড়ে স্টিলের কাঠামোয় আকার নেওয়া মাওয়া টোল প্লাজা। মাওয়া সংযোগ সড়কের পাশে শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে এটির। ওপরে লাগানো হচ্ছিল পাত। টোলঘরের ভেতরেও শেষ পর্যায়ের কাজ চলছিল। সংযোগ সড়কের পাশে লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের গাছের চারাও।

পদ্মার পারে প্রকল্প এলাকায় চলছিল নানা কাজ। ইটের পথ ধরে ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে স্প্যানের কাঠামো তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি ও অন্য কারিগরি সুবিধা প্রস্তুত করা হয়েছে। এক কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এই ইয়ার্ডের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা।

নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের বলেন, এখানে স্প্যান ফিটিং করা হবে। ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডের পাশে স্প্যান ফিটিং করার প্রস্তুতি দেখে হেঁটে পাশের কারখানায় গিয়ে জানা গেল সেটি পাইল তৈরির কারখানা। লম্বা কারখানায় এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে কোথাও পাত গোল করা হচ্ছিল, কোথাও পাত যন্ত্র দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছিল, কোথাও ওয়েল্ডিং করা হচ্ছিল। সোজা পাত গোলাকার করে ৪২টি গোলাকার অংশ (সেকশন) যোগ করে আকার দেওয়া হচ্ছে একেকটি পাইলের। এ কারখানায় ১৮ মাস ধরে পাইল তৈরি করা হচ্ছে। স্টিলের পাইল ১২২ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত নদীর গভীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারখানা থেকে পাইল বের করে নদীপথে নৌযানে করে নদীতে নিয়ে পাইলিং করা হচ্ছে। বর্তমানে জাজিরায় পাইলিংয়ের কাজ হচ্ছে। এ ছাড়া সেখানে গত সোমবার থেকে শুরু হয়েছে ভায়াডাক্ট (সংযোগ সেতু) এলাকায় পাইলিংয়ের কাজ। প্রকৌশলীরা সে জন্য মাটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। সেখানে পাইলিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়, নেওয়া হয় রিগ। গতকাল গিয়ে দেখা গেছে, মাওয়া ও জাজিরায় পদ্মা বেশ উত্তাল। তবে প্রবল স্রোত উপেক্ষা করেই চলছে কাজ। মাওয়া থেকে জাজিরায় নদীর বুকে ক্রেন, ড্রেজার, ভারী ভারী যন্ত্রে সেতু প্রকল্পের এসব কাজ চলছে। পাইলিংয়ের কাজে ব্যবহারের জন্য নেদারল্যান্ডস থেকে দুই হাজার কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামার অক্টোবরে আসবে মাওয়ায়। জার্মানি থেকে আনা দুই হাজার ৪০০ কিলোজুলের একটি হ্যামারসহ ছোট আরো চারটি হ্যামার রয়েছে। জানা গেছে, নদীর তলদেশের ৪০০ ফুট নিচে ১০০ ফুটজুড়ে কাদার স্তর পাওয়া গেছে। কোথাও মাটি অপেক্ষাকৃত নরম। বিশেষজ্ঞ কমিটির নির্দেশনা অনুসারে সেসব স্থানে কৌশলে পাইলিংয়ের প্রক্রিয়া শেষ করা হচ্ছে।

নিচে চলবে ট্রেন : পদ্মা সেতুর ৪২টি স্প্যান হবে দোতলাবিশিষ্ট। নিচে রেলপথ স্থাপনের সংস্থান রাখা হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু রেল সংযোগের কাজ শুরু হচ্ছে ডিসেম্বরে। চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড এ কাজ পেয়েছে। গত সোমবার রাজধানীর রেলভবনে রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের চুক্তি সই হয়েছে। ২০১৮ সালে মূল পদ্মা সেতু চালুর প্রথম দিন থেকেই এই রেলপথের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশ চালু করার কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনটি অংশের নির্মাণকাজ সাড়ে চার বছরে শেষ করা হবে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি প্রথম পর্যায়ে বিদ্যমান ঢাকা রেলস্টেশন (কমলাপুর) থেকে শুরু হয়ে গেণ্ডারিয়া-মাওয়া-পদ্মা সেতু (নির্মাণাধীন)-নির্মাণাধীন ভাঙ্গা স্টেশনকে যোগ করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাঙ্গা জংশন থেকে বিদ্যমান কাশিয়ানী জংশন স্টেশন হয়ে পদ্মবিলা জংশন হয়ে রূপদিয়া ও সিঙ্গিয়া স্টেশনকে সংযুক্ত করবে। ঢাকা-গেণ্ডারিয়া সেকশনে তিন কিলোমিটার ডবল লাইনসহ প্রকল্পের আওতায় মোট ১৭২ কিলোমিটার নতুন মূল রেলপথ নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প পরিচালক সাগরকৃষ্ণ চক্রবর্তী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের অগ্রাধিকারের এ প্রকল্প আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চাই। আশা করি, তিন মাসের মধ্যে চীন সরকারের সঙ্গে ঋণ চুক্তি হবে।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment