মাত্র ২২ দিনে অফিসের চিত্র পাল্টে দিলেন কেরাণীগঞ্জের এসিল্যান্ড পারভেজ

ঝকমকে গুছানো কার্যালয়। কেরাণীগঞ্জ উপজেলা কার্যালয়ের মেইন গেট দিয়ে ঢুকে বামে মোড় নিলে বাম পাশে রয়েছে রঙ্গন, গোলাপ, কৃষ্ণচূড়াসহ বিভিন্ন ফুলের ও ফলের বাগান । সামনে ঝুলছে বিভিন্ন সতর্কীকরন সাইনবোর্ড ।প্রধান ফটকের একেবারে বামদিকে দিকে একটি কার্যালয়। এটি সহকারী কমিশনার (ভূমি) পারভেজুর রহমানের কার্যালয় ।এর একেবারে বামের রুমটিতে বসেন নব নিযুক্ত সহকারী কমিশনার (ভূমি)পারভেজুর রহমান ।
কার্যালয়ের বাইরে দালালের দৌরাত্ম্য। কাজ মানেই টাকা, বাড়তি টাকা। সেবাপ্রার্থীর প্রতি কর্মচারীদের অবহেলা। ভ্রুক্ষেপহীন কর্মকর্তা। দিনের পর দিন হয়রানি—ভুক্তভোগীদের কাছে সারা দেশে এই হলো ভূমি কার্যালয়ের সাধারণ চিত্র। কেরাণীগঞ্জ ভূমি অফিসও একসময় দালালের স্বর্গরাজ্য ছিল। কিন্তু সবকিছু মাত্র ২২ দিনে বদলে দিয়েছেন পারভেজুর রহমান।

0187

অথচ ভাবতে অবাক লাগে মাত্র ২৩ দিন পূর্বেও কেরাণীগঞ্জ ভূমি অফিস মানেই ভুমি মালিকদের জন্য আতঙ্ক ছিল । এখানে একটি নামজারি মানে লক্ষাধিক টাকার খেলা ছিল ।অবৈধ টাকা লেনদেনের বাহন মিষ্টির খালি প্যাকেট সন্কট দেখা দিত । এখন কোন খালি প্যাকেট আর আসে না ভূমি আফিসে । জমি মালিকরা অপেক্ষায় থাকত কোনদিন একজন ভাল কর্মকর্তা আসবে এ ষ্টেশনে ।তিনি এলেন, পাল্টে দিলেন চিত্র ।সম্পূর্ণ আফিসকে সৌন্দর্য বর্ধণ করলেন ।যেন অচেনা এক অফিসে প্রতিবেদনের জন্য এসেছি ।আগের কিছুই যেন নেই, মনে হচ্ছে ভূলে অন্য কোন অফিসে এসেছি আসেলে তা নয়, এ চিত্রটা পাল্টে দিলেন বিসিএস প্রশাসনের ৩০তম ব্যাচের মেধাবী ক্যাডার সিলেটের গোলাপগঞ্জের কৃতি সন্তান জনাব পারভেজুর রহমান ।

তিনি নরসিংদী জেলা প্রশাসক অফিসের সহকারী কমিশনার থেকে বদলী হয়ে ৮ আগষ্ট,২০১৬ ইং তারিখে কেরাণীগঞ্জ সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেন ।তিনি যোগদানের পরদিনই নিজস্ব কর্মকর্তাদের সাথে মিটিং করে ঘোষণা দেন খ তফশিলের নামজারী সাব-রেজিষ্ট্রার দলিল সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিলে নামজারী কার্যক্রম হবে এর আগে নয় । সে মিটিংয়ের ফলশ্রুতিতে তিনি মাত্র ২২ দিনে মাদকের মামলা করেন ১৭টি তন্মধ্যে ৮টি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয় এবং আসামী করা হয়েছে ১২ জনকে বাকী ৯টি মামলায় জরিমানা করা হয় ৪৮ হাজার টাকা ।

উল্লেখযোগ্য ভূমি অফিসে দালালী করার জন্য আলী হোসেন (৩৫)ও মমতাজ আলী(৪০) উভয় সাং রোয়ারী, উপজেলা কেরাণীগঞ্জদেরকে পর্যায়ক্রমে ১০হাজার ও ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় ।মামলা নং ২৩৪/২০১৬ তারিখ ২৩/০৮?১৬ ইং ।

এ জয় করার জন্য তাকেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে কেননা খ তফসিলের নামজারীর দালালী করতেন এমন কিছু ব্যক্তি তাদের চাপের মুখে এসিল্যান্ড অনেক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন । তিনি এ ব্যাপারে জিরু টলারেটে রয়েছেন ।

এই ভূমি কার্যালয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখা যায়, নানা রকমের বোর্ডে নাগরিক সনদ, কর্মকর্তাদের কর্ম বন্টন, জমির নামজারি করতে কত টাকা লাগে, খতিয়ান তুলতে কত টাকা লাগে, খাসজমি বন্দোবস্ত নিতে কী করণীয়, কোন বিষয়ে কার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে, দালাল হতে সাবধান, ভূমি সেবা সহজীকরনের নানান সব তথ্য লেখা।
কার্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষের উপরে কর্মচারীদের নাম, শাখার নাম, কার কাছে কোন সেবা পাওয়া যাবে—তা লেখা
ভূমি কার্যালয়ের চিরচেনা দালাল ও জাল দলিল ও পর্চা তৈরীকারকের দল কোথায় গেল—জানতে চাইলে রেষ্টুরেন্ট মালিক আল আমিন বললেন, তাঁরা এখন আর এখানে ঢুকতে পারেন না। অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। দু-একজন এলেও বাইরে দোকানে বসে থাকেন।

 

চা দোকানদার মোঃ হারুন বলেন, আগে এখানে অনেক ভূমি অফিসের দালাল থাকত এবং জমি মালিকরা অনেকে কাজ নিয়ে হয়রানি হত । তারা প্রায় প্রতিদিনই এসে বসে থাকত এবং এ এলকা কানায় কানায় পূর্ণ থাকত ।এখন এ রকম ফাঁকা পড়ে থাকে লোকজন নেই ।

চা দোকানদার মোঃ বাসার বলেন, এখন ভূমি অফিসের কোন বাড়তি লোক নেই এবং রেজিষ্ট্রি অফিসের লোকও কম তাই চা বিক্রি করে সংসার চলা দায় হয়ে পড়েছে ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজনকে বাইরে পাওয়াও গেল। তিনি ক্রাইমভিশণকে ললেন, ‘কয়েক দিন আগে এসিল্যান্ড ২ জনকে জরিমানা দিয়েছেন । তাঁদের অবস্থা দেখে আমি এই পেশা ছেড়েই দিয়েছি।’

কেরাণীগঞ্জ ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, নামজারি রিভিউ (মিস কেস) এর পাইলটিং এর আওতায় ৬ মাসের মধ্যে মিস কেস সম্পন্ন করা হয়। নতুন প্রক্রিয়ায় সেবাপ্রাথী মোবাইলে এসএমেস এর মাধ্যমে তার পরবতী শুনানীর ডেট জ়ানতে পারবে, ওয়েবসাইত এর মাধ্যমে যে কোন জায়গা থেকে মিস কেস এর আবেদন করতে পারবে, ৬ মাসের মধ্যে তারা পুরোপুরি সেবা পাবে।

এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার(ভূমি) পারভেজুর রহমান বলেন, আমি অফিস দালালমুক্ত করেছি, বিনা বাঁধায় সেবা প্রার্থীরা সরাসরি আমার রুমে ঢুকে তাদের সমস্যার কথা জানাবে, খ তফসিলের জমি সাব রেজিষ্ট্রারের প্রতিবেদনের উপর নামজারী করে থাকি, যেকোনভাবেই হোক কেরাণীগঞ্জকে মাদকমুক্ত করবই, ঢাকার অদুরে ব্যস্ততম ভূমি অফিস হিসেবে উন্নত পরিবেশ থাকার কথা থাকলেও অফিসটি ছিল জরা জীর্ণ, তা এখন আর নেই । আশা করছি ভূমি অফিস সম্পর্কে সেবা প্রার্থীর ধারণা অল্প কয়েকদিনেই পরিবর্তন হতে শুরু করেছে ।

তিনি জানান, আমি যতদুর শুনেছি আগে দালালদের জন্য সেবা প্রার্থীরা কর্মকর্তাদের নিকট ভিড়তে পারিতেন না কিন্ত এখন তার ব্যতিক্রম ।আমি শক্তিশালী দালালদের জরিমানা করায় বাকীরা পালিয়েছে ।খুব শিগ্রই কমিশনার স্যার, ডিসি স্যার ও ইউএনও স্যারের সহযোগীতা নিয়ে দেশ সেরা পরিবেশ বান্ধব রেকর্ড রুম তৈরী করব । যাতে অল্প কয়েক মিনিটে গ্রাহক সেবা দিতে পারি ।

তিনি আরো জানান, নামজারি ও বিবিধ মামলার শুনানির তারিখ বাদী ও বিবাদীকে মোবাইলে খুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। উপজেলা ভূমি অফিসের নামে একটি ওয়েবসাইট খোলা হবে যার মাধ্যমে নামজারি ও বিবিধ মামলাসহ অন্যান্য আবেদন অনলাইনে দাখিল করার সুযোগ থাকবে। বিভিন্ন মামলার সর্বশেষ অবস্থাও ওয়েবসাইট থেকে জানা যাবে। জানানো যাবে যেকোনো অভিযোগ। উপজেলা ভূমি অফিসের ফেসবুক পেজেও এসি ল্যান্ডের কাছে যেকোনো সমস্যা জানানো যাবে।

এই সময়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) নথি ক্রমানুসারে সাজিয়ে প্রতিটির সঙ্গে ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছেননথিগুলোকে প্রথমা, দ্বিতীয়া তৃতীয়া নামের তিনটি কক্ষে এমনভাবে সাজিয়েছেন, এখন যেকোনো নথি এক মিনিটের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভবআগে একটা নথি খুঁজে বের করতেই দিন পার হয়ে যেতনথি খোঁজার জন্য কাউকে কাউকে ‘খুশি’ করতে হতো

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment