দুই জীবনের ঈদ : মমতাজ


বড় হয়েছি মানিকগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে, চরদূর্গাপুর গ্রাম। কখনোই আমার চাওয়া-পাওয়া খুব বেশি ছিল না, ছিলাম অল্পে তুষ্ট। বাবা ছিলেন বাউল। তাঁর সাধ্যও ছিল কম। চাইলেই তাই দুই হাতে খরচ করে বড় আয়োজনে ঈদ করতে পারতাম না আমরা। আর পাঁচজনের মতোই ঈদ আসত গরিবের ঘরে। ঈদ উপলক্ষে নতুন জামা পাওয়াটাই সেই সময় যেন বিরাট কিছু। আর রূপচর্চার জন্য প্রসাধন—তার কথা তো ভাবাই যেত না। আজ যখন নিজের দুই জীবনের ঈদের দিকে তাকাই, মনে হয়, হ্যাঁ, সামর্থ্য বেড়েছে; তবে খুব কি অদল-বদল ঘটেছে আনন্দের?
ছোট থেকেই ছিলাম গানপাগল ও বাপ-ন্যাওটা মেয়ে। বাবার ছিল দুটো পরিবার। কিন্তু সামর্থ্য ছিল কম। তাই আকাশে ঈদের চাঁদ উঠছে আর আমার বুক দুরুদুরু, এবার ঈদে জামা পাব তো?—একসময় এই ছিল বাস্তবতা।

e0a2a4712adb52719f97460087d70cac-untitled-32
আগের সঙ্গে এখনকার ঈদের বড় পার্থক্য একটি জায়গায়, ঈদের দিন আমরা বান্ধবীরা মিলে নদীতে যেতাম গোসল করতে। প্রথম কাজই ছিল এটি। তো, এই গোসলের সময় কে কী সাবান নিয়ে যাচ্ছি, এটাও কিন্তু বড় ব্যাপার।—ওই আনন্দটা এখন আর পাই না।
সব সময় নিজের চাওয়াকে সীমিত করে রাখতাম আমি। বুঝতে পারতাম, আমাদের সামর্থ্যের সীমা। আমার আট-নয় বছর বয়সে একবার শুধু একটি চাওয়া ছিল—সেবার দেখলাম, আমাদের চেয়ে একটু বড় যাঁরা, ঈদ উপলক্ষে তাঁরা তখন থ্রিপিস কিনছেন। এমনিতে বাবা আমাকে টুপিস দিতেন। কিন্তু আমি চাইলাম, থ্রিপিস। একটি থ্রিপিসের দাম কত সেই সময়? বড়জোর ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। কিন্তু আমার জন্য ঈদের বাজেট ছিল ১২০ কিংবা ১৫০ টাকার মতো। তাই বাবা বললেন, এটা কিনতে গেলে বেশি টাকা লাগবে, আমি তো এটা দিতে পারব না, মা। এখন টুপিসই নাও। তোমাকে অন্য কোনো সময় একটা ওড়না কিনে দেব। পরে অবশ্য ‘১৪ কিলোমিটার হাঁটা’র পুরস্কার হিসেবে ওড়নাও কিনে দিয়েছিলেন। সেই ঘটনাটা বলি। বাবার সঙ্গে একদিন ঢাকায় যাচ্ছি। আমাদের সিঙ্গাইরের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলত না, চলত রিকশা। তবে রিকশার ভাড়া ছিল অনেক বেশি। আর আমাদের তো রিকশায় যাওয়ার সামর্থ্যও ছিল না। তাই বাবা বলতেন, ‘বেশি দূর না। মাত্র সাত-আট কিলোমিটার। চলো, হেঁটেই যাই। হেমায়েতপুরে গিয়ে সেখান থেকে বাসে চড়ে মিরপুর যাব।’ বাবাকে বললাম, ‘ঠিক আছে, চলো।’
মাঝখানে খানিকটা পথ আসতে হতো নৌকায়। এরপর জোড়পোল থেকে উঠতাম বাসে। তো, যখন আমরা ঢাকা যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠব, তখন বাবা টের পেলেন দরকারি কিছু কাগজপত্রসহ তাঁর হাতে থাকা ব্যাগটি নেই। ওটা তিনি ফেলে এসেছেন সাত কিলোমিটার দূরে, এক চায়ের দোকানে। সেই সময় তাঁর পাগল-পাগল অবস্থা। আমাকে বাবা বললেন, ‘তুমি না একটা ওড়না চাইছিলা? যদি যাইয়া আমার ব্যাগটা নিয়ে আসতে পারো, তাইলে ঢাকায় গিয়া আমি তোমারে ওড়নাটা কিনা দিব।’
সাত কিলোমিটার পথ। আসতে-যেতে ১৪ কিলোমিটার। একটা ওড়নার লোভে সেই পথ পাড়ি দিয়েছিলাম। ঢাকায় এসে মিরপুর মাজার রোডের এক দোকান থেকে আমাকে লাল টুকটুকে ওড়না কিনে দিলেন বাবা। তখন আমার খুশি দেখে কে!
ঈদের দিন ভোরবেলা গোসল সেরে এসে খেতাম মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই। খাওয়াদাওয়া নিয়ে খুব বেশি আয়োজনের সাধ্য কী আমাদের—মাত্র একটি বা দুটো পদ—সেমাই আর খিচুড়ি। সম্ভব হলে এর সঙ্গে থাকত মুরগির মাংস। আমাদের কাছে ওই-ই ছিল শাহি ভোজ।
এখন প্রতি ঈদেই মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। তাদের কাপড়চোপড় দিই, টাকাপয়সা দিয়েও সাহায্য করি। যখন আমার দেওয়া কাপড় পেয়ে ঝলমলিয়ে ওঠে কোনো মুখ, কী যে আনন্দ হয়!
হয়তো কোনো এক মাকে ঈদ উপলক্ষে কাপড় দিচ্ছি আমি, তখন যদি ওই মায়ের ছোট বাচ্চাটি পাশে এসে দাঁড়ায়, ওর হাতেও গুঁজে দিই কিছু টাকা। ভীষণ খুশি হয় ওরা। আর ওদের খুশি দেখে আমার মনে পড়ে নিজের কথা। মনে হয়, আমি তো এ রকম জায়গা থেকেই উঠে এসেছি।
ঈদের দিন বাসার মানুষকে খুশি রাখতে পারলেই অদ্ভুত এক আনন্দ হয়, ভালো লাগে। আর আমার আত্মীয়স্বজন ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, যাঁরাই আমার সঙ্গী, চাই সবাই খুশি থাকুক ঈদের দিনে।


কেউ কেউ ভাবতে পারেন, মমতাজ অনেক কিছু। সে সাংসদ। আমি আদতে তেমন কিছুই নই। এখনো আমি গান করে খাই। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে অনুষ্ঠান করি, গান গাই। সে জন্য নতুন শাড়ি কিনি। না, বিলাসিতার কারণে নয়, অনেকটা প্রয়োজনেই। কেননা, গানবাজনাই যেহেতু আমার রুটি-রুজি, তাই অনুষ্ঠানে নিজেকে পরিপাটি করে রাখাও তো চাই।
কয়েক বছর ধরে চাঁদরাতে সরাসরি গানের অনুষ্ঠান করি আমি। গভীর রাত পর্যন্ত চলে সেই অনুষ্ঠান। অবশ্য আমার বাচ্চারা ঈদের আগের দিনই গ্রামে চলে যায়। চাঁদরাতের অনুষ্ঠান শেষে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে আমিও গ্রামের পথ ধরি।
গ্রামে গেলে নামাজ শেষ করে সবাই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সবার সঙ্গে গল্প করতে করতে কীভাবে যেন সময় কেটে যায়। বাচ্চারা সারা দিন অনেক মজা করে। ওরা থাকতে চাইলে ঈদের দিন গ্রামেই থেকে যাই। না হলে রাতেই ফিরে আসি ঢাকায়। ফিরতে ফিরতে ছোটবেলার ঈদগুলো চোখে ভাসে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো। ভাবি, আমার দুই জীবনের ঈদের রং ভিন্ন হলেও একই রকম উজ্জ্বল।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment