স্বামী-স্ত্রী যখন আত্মঘাতী জঙ্গি!

স্বামী-স্ত্রী যখন আত্মঘাতী জঙ্গি!

রাজধানীর আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানার অন্তত তিনজন নব্য জেএমবির ‘আত্মঘাতী’ দলের সদস্য বলে দাবি করছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন পুলিশের অভিযানের সময় ‘আত্মহত্যা’ করেছে। এখন পর্যন্ত জানা গেছে, তার প্রকৃত নাম তানভীর কাদেরী। তবে সে নিজেকে জামসেদ পরিচয়ে চলতি বছরের ১ আগস্ট বিজিবির ২ নম্বর গেটসংলগ্ন আজিমপুরের ২০৯/৫ নম্বরে ছয়তলা বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাদেরীর গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা। সে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র অফিসার। জেএমবিতে যোগ দিতে বছরখানেক আগে কাদেরী চাকরি ছাড়ে। সংগঠনে সে সামশেদ হোসেন নামেও পরিচিত। হলি আর্টিসানে হামলাকারীদের বসুন্ধরায় বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছিল সে।

আজিমপুরে বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভাড়াটিয়া হিসেবে চুক্তিপত্রে কাদেরী জানায়, ‘তার বাড়ি রাজশাহীর বোয়ালিয়ায়।’ শনিবার রাতে পুলিশের অভিযানে কাদেরীর বাসা থেকে দু’জন ও পালিয়ে যাওয়ার সময় যে এক নারীকে আহতাবস্থায় আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে নব্য জেএমবির সামরিক প্রশিক্ষক মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা নেই। ওই তিন নারীর পরিচয় নিশ্চিত হতে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।

গোয়েন্দারা বলছেন, তাদের মধ্যে রয়েছে জেএমবির আরেক শীর্ষ নেতা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী প্রিয়তী, জেএমবি নেতা পলাতক চকোলেট ওরফে বাশারুল্লাহ ওরফে সাকিবের স্ত্রী শারমিন ওরফে শায়লা ও ব্যাংক কর্মকর্তা কাদেরীর স্ত্রী। ওই জঙ্গি আস্তানায় প্রিয়তী ও কাদেরীর স্ত্রী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। তবে বাশারুল্লাহর স্ত্রী শায়েলা ১০ মাস বয়সী শিশুকে ওই ফ্ল্যাটে রেখে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। স্থানীয় জনতার সহায়তায় তাকে বাসার সামনের সড়ক থেকে আটক করে পুলিশ। আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর আটক তিন নারী বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া ওই আস্তানায় জাহিদুলের সাত বছর বয়সের মেয়ে, কাদেরীর ১৩ বছর বয়সের ছেলে ও বাশারুল্লাহর ১০ মাস বয়সের শিশুকে পাওয়া গেছে। তাদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রেখেছে পুলিশ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশ এক রাউন্ডও গুলি করেনি। ওই আস্তানায় এক জঙ্গি নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। অপর দুই নারী জঙ্গি আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছিল।

আগস্টে বাসা ভাড়া নেয় ‘জামসেদ’: বিজিবির ২ নম্বর গেটসংলগ্ন আজিমপুরের ২০৯/৫ নম্বরে ছয়তলা বাড়িটির দোতলার একটি ফ্ল্যাট আগস্ট মাসে ভাড়া নেয় আবদুল করিম ওরফে জামসেদ ওরফে সামশেদ হোসেন ওরফে তানভীর কাদেরী। তবে বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার সময় সে নিজেকে জামসেদ পরিচয় দেয়। ওই নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্রও জমা দেওয়া হয়। গ্রামের বাড়ির কথা বলা হয় রাজশাহীতে। তবে পুলিশ জানতে পেরেছে, ওই পরিচয়পত্র ভুয়া।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথিত জামসেদ এক বছরের বাড়ি ভাড়া চুক্তি করেছিল। ১ আগস্ট সে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ওই বাসায় ওঠে। শনিবার রাতে অভিযানের পর দেখা গেছে, চার কক্ষের বাসার দুটি কক্ষে নিম্নমানের দুটি খাট রয়েছে। এক কক্ষে একটি টেবিল ছাড়া অন্য কোনো আসবাব নেই।

তিন নারী কারা: শনিবার রাতে অভিযানের পর পুলিশ কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলেছিলেন, আস্তানায় আহত তিন নারীর একজন নিহত জাহিদুলের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা হতে পারে। তবে আহত তিন নারী জঙ্গিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, ওই তিনজনের মধ্যে জাহিদুলের স্ত্রী নেই। তবে তিন নারী কারা? কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন নারীর একজন শারমিন। অভিযানের মুখে পিস্তল দিয়ে গুলি করতে করতে সে আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসে। একপর্যায়ে রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন তাকে ধরে ফেলে। শারমিনের স্বামী ‘চকোলেট’ও নব্য জেএমবির প্রথম সারির নেতা। পুলিশ তাকে খুঁজছে। অপর একজন আত্মঘাতী কাদেরীর স্ত্রী। অন্য নারী পলাতক জঙ্গি মানিক বা মারজানের স্ত্রী হতে পারে।

নতুন কমান্ডার হতে চেয়েছিল কাদেরী: দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, তামিম চৌধুরী ও জাহিদুল ইসলাম নিহতের পর নব্য জেএমবির হাল ধরতে চেয়েছিল কাদেরী। নিহত জঙ্গিদের স্ত্রী ও অন্যান্য স্বজনের সে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছিল। তার বাসায় কিছু দিন ধরেই বসবাস করে আসছিল জাহিদুলের স্ত্রী জেবুন্নাহার। কাদেরীর যমজ সন্তান রয়েছে। এক সন্তানকে আজিমপুরের বাসায় রেখে আরেকজনকে ‘ফিদাহ’ বানাতে অন্যত্র পাঠিয়েছে। আর আজিমপুরে বাসায় ১৩ বছর বয়সী কাদেরীর যে সন্তানকে পাওয়া গেছে, সে তার নাম ‘রাসেল’ বলে জানিয়েছে। একসময় সে মাইলস্টোন কলেজে পড়ত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, শনিবার রাতে পুলিশের অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে তার বাবা বাসার সবার হাতে অস্ত্র, ছুরি, চাপাতি ও মরিচের গুঁড়া দিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে বলে।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, দোতলায় ওই বাসায় গেলে কৌশলে একটি কক্ষে পুলিশের দুই সদস্যকে আটকে রেখে দরজা বন্ধ করে দেয় জঙ্গিরা। পরে পুলিশের অন্য একটি টিম গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। ওই বাসা থেকে চারটি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫০ রাউন্ড গুলি, চার লাখ দুই হাজার টাকা ও বেশ কিছু ইলেকট্রনিক ভিভাইস উদ্ধার করা হয়েছে।

সূত্র বলছে, সম্প্রতি এক ব্যক্তি ওই বাসায় গিয়ে কাদেরীর হাতে ১০ লাখ দিয়েছে- এমন কিছু আলামত পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ছয় লাখ টাকা খরচ করেছে কাদেরী। বাকি টাকা ওই বাসায় পাওয়া গেছে। সূত্র বলছে, রূপনগরে সম্প্রতি অভিযানের পর গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, সাবেক এক ব্যাংক কর্মকর্তা যমজ সন্তান ও স্ত্রীসহ বাসা ভাড়া নিয়ে জঙ্গিদের আশ্রয় দিচ্ছে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে কাদেরী যমজ সন্তানের একজনকে ‘ফিদাহ’ বানাতে অন্যত্র সরিয়ে নেয়।

শিশুসন্তান রেখেই পালিয়েছিল শারমিন: আজিমপুরের আস্তানায় ১০ মাস বয়সী একটি মেয়েশিশুকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, ফুটফুটে ওই শিশুর মা আহত নারী জঙ্গি শারমিন। যে নিজের আদরের সন্তানকে ঘরে রেখেই পালানোর চেষ্টা করে। যদিও পালানোর সময় পুলিশের সঙ্গে ‘ভয়ঙ্কর’ ওই নারীর সংঘর্ষ হয়। তাকে রাস্তার ওপর পুলিশ গুলি করার পর সে ধারালো ছুরি বের করে এগোতে থাকে।

বিভ্রান্ত করছে ছোট ছেলেটিও: আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া রাসেল নামের ছোট ছেলেটির বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তবে এখনই সে তার মা-বাবার কথিত আদর্শের অনুসারী হয়ে পড়েছে! পুলিশের কাছে নিজের নাম রাসেল এবং বাবার নাম জমসেদ বললেও পুলিশের কাছে থাকা তথ্যে তা মিলছে না। প্রাথমিকভাবে পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, ছোট শিশুটি তাদের বিভ্রান্ত করছে। মা-বাবা সম্পর্কে তথ্য লুকাতে চাইছে। ধারণা করা হচ্ছে, সে নিজেকে রাসেল পরিচয় দিলেও এটি তার প্রকৃত নাম নয়।

গলায় ছুরি চালিয়েছে সেই জঙ্গি: কথিত আবদুল করিম ওরফে জামসেদ ওরফে সামশেদ হোসেন ওরফে কাদেরীর শরীরে গুলির কোনো চিহ্ন পাননি ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। তার গলা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটা ছিল। এ ছাড়া তার বুকে, হাতে ও পিঠে হালকা জখমের চিহ্ন রয়েছে। ওই জঙ্গি গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত করেছে বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের ধারণা। গতকাল রোববার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে তার ময়নাতদন্ত হয়।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ জানান, ওই যুবকের গলার বাঁ পাশে কাটা জখম রয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।

সোহেল মাহমুদ বলেন, কেউ সুইসাইড করলে ডান হাতে ছুরি ধরে বাঁ গলায় আঘাত করে থাকে। ওই যুবকের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। আত্মহত্যার সব ধরনের নমুনাই পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তার শরীরে হাতে একটি, বুকে তিনটি ও পিঠে একটি ছোট আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিরা সাধারণত বোমা বা গ্রেনেড ব্যবহার করে আত্মঘাতী হয়। আজিমপুরের ঘটনায় এর ব্যতিক্রম হয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, আস্তানাটিতে জঙ্গিদের কাছে বিস্ফোরকের মজুদ কম ছিল। প্রথমে তারা দুটি হ্যান্ডগ্রেনেড বিস্ফোরণ করলেও পরে ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে আর কোনো তাজা গ্রেনেড পাওয়া যায়নি।সমকাল

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment