দুর্নীতির ‘সূচক’: ৪.৩ থেকে ২৮ পয়েন্ট বাংলাদেশের

দুর্নীতির ‘সূচক’: ৪.৩ থেকে ২৮ পয়েন্ট বাংলাদেশের

বিশ্বে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো নিচের দিকে। তবে প্রায় দেড় যুগ আগের কথা চিন্তু করলে সবশেষ স্কোর আর অবস্থান কিছুটা স্বস্তিদায়কই বলা যাবে।
দুর্নীতির ‘সূচক’: ৪.৩ থেকে ২৮ পয়েন্ট বাংলাদেশের

২০০১ সালে বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকায় স্থান পাওয়া বাংলাদেশের স্কোর ছিল ০.৪৩। এখন যে মানদণ্ডে স্কোর করা হয়, সে হিসাবে অবশ্য একা ৪.৩। আর সবশেষ প্রকাশিক তালিকায় বাংলাদেশের স্কোর ২৮, তার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭। এক বছরে বাংলাদেশের যেমন দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে, তেমনি স্কোর যেমন বেড়েছে ২।

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রকোপ একটি সাধারণ সমস্যা। দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব যেমন প্রকট, তেমনি সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত এবং বেসরকারি সংস্থায় ও প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষের প্রবণতাও আছে ব্যাপকহারে। তবে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনার বিষয়টি প্রথম প্রকাশ পায় ২০০১ সালে।

ওই বছর বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করে বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-টিআই বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি পায়। যদিও সংস্থাটি এই সূচক প্রকাশ করে আসছিল তারও ছয় বছর আগে থেকেই।

টিআই সূচকে অন্তর্ভুক্তির বছরেই দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের সারা বিশ্বে সবচেয়ে তলানিতে অবস্থানের তথ্যে তোলপাড় হয়ে যায় দেশে। আর একই সময় টিআইএর বাংলাদেশ শাখা টিআইবিও প্রতিষ্ঠা পায় বাংলাদেশে।

অবশ্য এই দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রণয়নে টিআইবির ভূমিকা নেই। মোট ১৩টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যে করা টিআইএর ধারণাসূচকটি টিআইবিই প্রকাশ করে। তারা বাংলাদেশে দুর্নীতি ও সুশাসন নিয়ে নানা গবেষণা চালায়।

২০০১ সাল থেকে টিআইবির প্রকাশ করা এই ধারণা সূচকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ধীরে হলেও উন্নতির দিকে যাচ্ছে। টানা পাঁচ বছর শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও পরে উন্নতি যেমন হয়েছে, দুই একটি বছর ছাড়া প্রতি বছরই স্কোরও বেড়েছে।

অবশ্য কোনো কোনো তালিকায় বছর নতুন দেশের অন্তর্ভুক্তি বা কোনো দেশের নাম বাদ দেয়ায় তালিকায় হেরফের হয়।

তবে উন্নতি করলেও ‘সহনীয় মাত্রার’ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় উঠতে বাংলাদেশের আরও বেশ কষ্ট করতে হবে। ১০০ ভিত্তিতে ৪৩ স্কোরকে গড় স্কেল করে এই হিসেব বিবেচনা করা হয়। এই স্কেলে শূন্য স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসনের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর গড় এর ওপর স্কোর হলে দুর্নীতি ‘সহনীয় মাত্রার’ ধরা যেতে পারে।

কোন বছরে কত স্কোর, অবস্থান কত

২০০১ সালে যখন টিআই সূচকে বাংলাদেশকে যখন দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বিশ্বে এক নম্বরে রাখা হয়, তখন বাংলাদেশর স্কোর ছিল ০.৪৩। তখন সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ১০, এখন সেটা ১০০। ১০০ হিসাব করলে তখন স্কোর ছিল ৪.৩।

ওই বছর আওয়ামী লীগ ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। আর এই স্কোর ও তালিকা প্রকাশের পর তোলপাড় পড়ে যায় দেশে। ব্যাপক চাপের মুখে পড়তে হয় সরকারকে।

ধারণা করা হয় ওই বছরের সাধারণ নির্বাচনে সে সময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল এই বিষয়টি। তবে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলের চার বছর এ বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি। পরপর পাঁচ বছর বাংলাদেশ ‘শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ’ হিসেবেই স্বীকৃতি পায়।

তবে ২০০১ সালের তথ্যের ভিত্তিতে ২০০২ সালে প্রকাশিত জরিপে বাংলাদেশের স্কোর বেড়ে হয় ১.২ (বর্তমান মানদণ্ডে ১২)। পরের বছর প্রকাশিত তালিকায় স্কোর হয় ১.৩ (বর্তমান মানদণ্ডে ১৩)

২০০৪ সালে প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশের স্কোর হয় ১.৫ (বর্তমান মানদণ্ডে ১৫)। ২০০৫ সালে এই পয়েন্ট আরও একটু বেড়ে হয় ১.৭ (বর্তমান মানদণ্ডে ১৭)

জোট সরকারের শেষ বছরে ২০০৬ সালে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে এসে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ৩ এ। সে বছর বাংলাদেশের স্কোর হয় ২ (বর্তমান মানদণ্ডে ২০)।

২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে সূচকে উন্নতি আরও দ্রুতগতিতে হতে থাকে। তবে মাঝে এক বছর বাংলাদেশের স্কোর কমেছে।

২০০৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ৭ এ। যদিও স্কোর বাড়েনি। নতুন দেশের অন্তর্ভুক্তি এবং তারা সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় পড়ে যাওয়াতেই উন্নতি হয় বাংলাদেশের।

২০০৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১০ এ। ওই বছর স্কোর সামান্য বেড়ে হয় ২.১ (বর্তমান মানদণ্ডে ২১)

২০০৯ সালে ২.৪ (বর্তমান মানদণ্ডে ২৪) স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৩।

২০১০ সালে একই স্কোর নিয়েই বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১২তে।

২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান আবার এক ধাপ নেমে গিয়ে হয় ১৩তে। যদিও এক বছরে বাংলাদেশের স্কোর বাড়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। তখন বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ২.৭ (বর্তমান মানদণ্ডে ২৭)

২০১২ সাল থেকেই সর্বোচ্চ নম্বর ১০০ ধরে সূচক প্রকাশ করা হচ্ছে। ওই বছর বাংলাদেশের স্কোর এক কমে ২৬ এ নেমে এলেও বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম স্থানেই থাকে। ওই বছর অবশ্য গোটা বিশ্বেই স্কোর কমে গিয়েছিল।

২০১৩ সালে আবার বাংলাদেশের স্কোর বেড়ে ২০১১ সালের অবস্থানে ২৭ এ পৌঁছে। আর সে বছর বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৬তম।

২০১৪ সালে বাংলাদেশর আবার অবনমন ঘটে। ওই বছর স্কোর যেমন দুই পয়েন্ট কমে হয় ২৫, তেমনি বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ কমে হয় ১৪ তম।

২০১৫ সালেও স্কোর সমান থাকে, আর বাংলাদেশের অবস্থান আরও এক ধাপ কমে হয় ১৩তম।
দুর্নীতির ‘সূচক’: ৪.৩ থেকে ২৮ পয়েন্ট বাংলাদেশের

২০১৬ সালে বাংলাদেশের স্কোর এক পয়েন্ট যেমন বাড়ে, তেমনি সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দুই ধাপ উন্নতি হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৫তে।

আর চলতি বছর স্কোর দুই পয়েন্ট বাড়ার পাশাপাশি অবস্থানও দুই ধাপ বেড়েছে।

ভারত পাকিস্তানের চেয়ে খারাপ স্কোর

বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নতি হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশেষ করে পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে।

টিআই-এর জরিপ ২০১৭ অনুযায়ী, দুর্নীতির বিচারে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৩। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের নিচে আছে কেবল আফগানিস্তান।

দক্ষিণ এশিয়ায় দুই আলোচিত দেশ ভারত আছে নিচের দিক থেকে ৮১ নম্বরে। আর পাকিস্তানের অবস্থান ১১৭ তে। এ ক্ষেত্রে ভারতের স্কোর ৪০ আর পাকিস্তানের ৩২।

উন্নতিধীর’, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি দূর করার তাগিদ

সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি হলেও সেটা ধীরগতির বলে মনে করেন টিআই এর বাংলাদেশ শাখা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি সূচকে আমরা যে উন্নতি করছি সেটা খুবই ধীরগতিতে হচ্ছে। এবারের সূচকে আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি কাঠামোতে তুলনামূলকভাবে সুদৃঢ় অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ এবার সূচকে সামান্য এগিয়েছে।’

ব্যাংকি খাতে খেলাপি ঋণ ও ঋণ জালিয়াতির বিচার ও টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হলে স্কোর ও অবস্থানের দিক থেকে অনেক উন্নতি হবে বলে মনে করেন টিআইবি প্রধান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে ক্রমবর্ধমান অনৈতিক প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম ও দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলায় জড়িত ও সহায়তাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে তথা জবাবদিহিতা নিশ্চিতে আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেতে পারি।’

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর সামাজিক মূল্যবোধ বা সামাজিক নৈতিকতার উন্নতি ছাড়া দ্রুত উন্নতি সম্ভব নয বলেও মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান।

আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটা অস্ত্র হতে পারে বলেও মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। সেই সঙ্গে আলোচিত বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনাগুলোর বিচার দৃশ্যমান হলে সেটি দুর্নীতি কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment