পৃথুলা ‘নারী পাইলট’ বলেই এমন নোংরামি?

পৃথুলা ‘নারী পাইলট’ বলেই এমন নোংরামি?

নেপালের কাঠমুন্ডুতে বিধ্বস্ত ইউ এস বাংলার বিমানের ফাস্ট অফিসার ছিলেন পৃথুলা রশিদ। ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের সাথে বিমানটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন এই তরুণ উদ্যমী অফিসার। ব্যস, আমাদের দেশের যাবতীয় শুষিল ফেসবুকীয় বিচারকেরা রায় দুয়ে দিলেন, “মাইয়া মানুষেরে প্লেন চালাইতে দিলে সেইটা বাস্ট হইবো না তো কি হইবো!”

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গতকাল থেকে অনলাইনে অসংখ্য মানুষ দ্বিপদ বিশিষ্ট মানুষের মত দেখতে প্রাণীরা মিডিয়া ট্রায়ালে এই রায় দিয়ে বেড়াচ্ছেন যে ফাস্ট অফিসার একজন নারী হওয়াতেই নাকি ইউ এস বাংলার এই বিমানটি ক্রাশ করেছে। কতটা নির্লজ্জ নির্মম নিকৃষ্ট কীট হলে এতোগুলো মানুষের মৃতদেহ ঠাণ্ডা হবার আগেই এমন কুৎসিত ব্লেইম গেইম খেলা সম্ভব? অথচ বিমানের ক্যাপ্টেন ছিলেন আবিদ সুলতান, পাঁচ হাজার ঘন্টারও বেশি বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই পাইলট ভুল কোঅর্ডিনেশনের দুর্ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলেন না তার বিমানকে, অথচ এই নির্লজ্জ পুরুষতান্ত্রিক কীটগুলো সেসব নিয়ে একটা কথাও না বলে সহজ টার্গেট হিসেবে পৃথুলার উপর সব দোষ চাপিয়ে প্রশ্ন তুলছে কেন একজন নারীকে বিমান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে! এরা কি মানুষের গর্ভে মানুষের ঔরসে জন্মেছিল আদৌ?

অথচ এই পৃথুলা কি করেছে জানেন? মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপ্রাণ চেস্টায় কমপক্ষে ১০ জন নেপালী নাগরিকের জীবনের বাঁচিয়ে গেছে সে। দুর্ঘটনা কবলিত বোমবার্ডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ৪০০ উড়োজাহাজটিতে ৩৭ জন পুরুষ ও ২৭ জন নারী ছাড়াও উড়োজাহাজটিতে ছিল দুটি শিশু। Sikkim Messenger নামের একটি নেপালী ফেসবুক পেইজসহ নেপালের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে পৃথুলাকে ডটার অফ বাংলাদেশ সম্বোধন করে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত পৃথুলা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছে যাত্রীদের বাঁচানোর জন্য, তার নিজের জীবন উৎসর্গ করে করা আপ্রাণ চেষ্টায় কমপক্ষে ১০ জন নেপালী এই ক্রাশ থেকে সার্ভাইভ করে বেঁচে আছেন। সিকিম মেসেঞ্জারের পোষ্টটি এখানে উল্লেখ করা হলোঃ

Daughter of Bangladesh sacrificed her life while saving the citizens of Nepal today :
This young Pilot from Bangladesh dies in a tragic plane crash today in Kathmandu while saving Nepali citizens
Her name was Miss Pritula Rashid. She was a Co-Pilot of #USBanglaAirlines (Flight BS211) which crashed today in Tribhuwan Airport of Kathmandu in Nepal today. However, she tried her best to save around 10 Nepali nationals before she died, who are alive now.

অথচ এই বীর নারীকে আমাদের দেশের কিছু নষ্ট জন্মের ফল বিমান দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে, পুরো দায় চাপাচ্ছে পৃথুলার উপর, কেন মেয়েদের বিমান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে তার জবাবদিহি দাবী করছে। তাদের ভাষায় মেয়েরা যাই করবে, সেটাতেই সমস্যা হবে, ধংস হবে, এক বরাহশাবক তো নারী কোটা টেনে আনলো এখানে, ইউ এস বাংলার পাইলট নাকি নারী কোটায় বিমান পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন! অথচ এরা একবারও এটা বলে না যে যদি একজন নারী বিমান পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় বিমান বিধ্বস্ত হয়, তাহলে এই যে প্রতিদিন হাজারো দুর্ঘটনা ঘটছে সড়কপথে, সেখানে যানবাহন চালানোর দায়িত্বে পুরুষ থাকায় কি দুর্ঘটনার দোষ পুরুষকে দেবো? এটা কি ধরনের নিকৃষ্ট চিন্তাভাবনা!

কি অদ্ভুত নির্লজ্জ এরা, কতটা জঘন্য এদের চিন্তাভাবনা! অথচ একটা বিমান যখন ক্রাশ হয়, দুমড়ে মুচড়ে যায়, সেই ভয়ংকর সময়ে নিজের জীবন বাঁচানোই অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারো হাতেই নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এখানেই আমাদের পৃথুলার অসামান্য কর্তব্যবোধ আর অসামান্য দক্ষতার পরিচয় উঠে আসে। সে জানতো যে তার হাতে খুব বেশি সময় নেই, তবুও তার মধ্যেই নিজের জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন তুচ্ছ করে অসাধারণ দক্ষতা আর পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে বাঁচিয়েছে কমপক্ষে ১০জন যাত্রীর জীবন। মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরত্বপূর্ণ আর আপন তার নিজের জীবন, কিন্তু পৃথুলা সেই প্রার্থিত জীবনের মায়ার বহু উপরে উঠে গিয়ে চেষ্টা করেছেন তার দায়িত্ব পালনের। জীবন বাঁচানোর চেষ্টা তো সবাই করে, কিন্তু সফল হয় কয়জন? পৃথুলা সেখানেও আপন যোগ্যতা, দক্ষতায় সফল হয়েছেন, নিজের জীবনের বিনিময়ে বাঁচিয়েছেন ১০টি প্রাণ, সুচারুরূপে পালন করে গেছেন নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও! এরপরেও কিভাবে কোন যুক্তিতে আমরা তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন?

প্রশ্ন তুলি কারণ আমরা আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্লজ্জ জাতি, নিকৃষ্টতম আমাদের চিন্তাচেতনা, ভয়ংকর নির্মম আমাদের বিবেচনাবোধ! নারীদের সবসময় পায়ের তলে রাখার মানসিকতা লালন করতে করতে, তাদের দাস-কামলা বানিয়ে খাটানোর ইচ্ছা থেকে আমরা যেখানে সেখানে যখন-তখন নারীদের অবমাননা করি, অপদস্ত করি, তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে, তাদের বাতিল এবং অদক্ষ হিসেবে রায় দিয়ে অর্গাজমের সুখ অনুভবের চেষ্টা করি।

আমরা, ফেসবুকের জ্ঞানী-বুদ্ধিজীবী ধার্মিক ভদ্র সমাজ বিচারকেরা গতকাল থেকে পৃথুলাকে নিয়ে যতগুলো জঘন্য আর নোংরা কথা বলেছি, আমরা আসলে নোংরামিটা করেছি আমাদের মা’কে, বোনকে, স্ত্রীকে, মেয়েকে নিয়েই, আমাদের জন্ম পরিচয় নিয়েই!

 

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment