১৫০০ কি.মি. সড়কই চলাচলের অযোগ্য সওজের প্রতিবেদন : সংস্কারে প্রয়োজন ২১ হাজার কোটি টাকা, ঈদযাত্রায় দুর্ভোগের শঙ্কা

আগের চেয়ে উন্নতি হলেও সড়ক-মহাসড়কের এক- চতুর্থাংশ এখনও ভাঙাচোরা। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে রাস্তার ২৬ দশমিক ৩২ শতাংশের অবস্থা বেহাল। মহাসড়কের ৫৭ ভাগ ভালো হলেও সারাদেশে দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশি রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ, চলাচলের অযোগ্য। এক হাজার ৭৩ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খারাপ। খুব খারাপ রাস্তাও আগের বছরগুলোর তুলনায় বেড়েছে। এর প্রভাব পড়তে পারে আসন্ন ঈদযাত্রায়।

জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক এই ক্যাটাগরিতে সওজের অধীনে সারাদেশে প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক রয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সারাদেশের ১৭ হাজার ৯৭৬ কিলোমিটার রাস্তা জরিপ করে এইচডিএম। জরিপের ভিত্তিতে ২০১৭-১৮ সালের প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, সারাদেশের ৫৩ ভাগ সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ভালো। আগের বছরে ভালো ছিল ৩৯ ভাগ রাস্তা। তার আগের বছরে মাত্র ১৯ ভাগ রাস্তা ভালো ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাঙাচোরা সড়ক মেরামত, পুনর্নির্মাণে আগামী পাঁচ বছরে প্রয়োজন ২১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে প্রয়োজন ১৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এইচডিএমের আগের বছরের প্রতিবেদনে ১২ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। তবে চলতি অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ এক হাজার ৭০৪ কোটি টাকা।

সড়কের এক-চতুর্থাংশ ভাঙাচোরার জন্য গত বছরের বন্যাকে দায়ী করেছেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সওজ কর্মকর্তারা। সড়ক পরিবহন সচিব নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, গত বন্যায় ও অতিবর্ষণে দেশের ২২টি জেলার ৬২ স্থানে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়ক বিলীন হয়ে যায়। ৬৭ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক বন্যায় তলিয়ে যায়। পাঁচ হাজার ১১৫ কিলোমিটার মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইচডিএমের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাক সমকালকে বলেছেন, প্রতিবেদনে ভালো, মোটামুটি, দুর্বল, খারাপ, খুব খারাপ; এই পাঁচ ভাগে তুলে ধরা হয়েছে রাস্তার অবস্থা। খারাপ রাস্তা বলতে বোঝানো হয়েছে- যেখানে পেভমেন্ট ভেঙে গেছে, সড়কে বড় বড় ফাটল ও খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। খুব খারাপ সড়ক মানে সেখানে যান চলাচলে খুব সমস্যা হয়। এগুলো জরুরি ভিত্তিতে মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন।

এইচডিএমের গত বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮৪০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। চলাচল অযোগ্য রাস্তা এবার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছরে খারাপ রাস্তা ছিল এক হাজার ৯০০ কিলোমিটার। চলতি বছরে তা কমে হয়েছে এক হাজার ৭৩ কিলোমিটার। এ উন্নতির বিষয়ে সওজের রক্ষণাবেক্ষণ উইংয়ের একজন প্রকৌশলী সমকালকে বলেন, খারাপ রাস্তার আকার আসলে কমেনি। সঠিক সময়ে মেরামত না করায় খারাপ রাস্তা খুব খারাপে পরিণত হয়েছে।

 

এইচডিএমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশের ৯ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা ভালো। যা জরিপকৃত সড়কের ৫৩ দশমিক ৬৩ ভাগ। তিন হাজার ৬০৪ কিলোমিটারের অবস্থা মোটামুটি। দুই হাজার ১১৫ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা দুর্বল।

চলাচলের অযোগ্য সড়ক বাড়লেও সড়ক-মহাসড়কের উন্নতিও হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী সড়ক-মহাসড়কের মাত্র ১৯ দশমিক ৬৪ ভাগ ছিল ভালো। ২০১৬-১৭ সালে জরিপকৃত ১৬ হাজার ২২০ কিলোমিটার রাস্তার ৩৯ ভাগ ছিল ভালো। এবার ভালো রাস্তা ১৪ শতাংশ বেড়েছে।

সারাদেশের তিন হাজার ৮১২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের তিন হাজার ৭৬০ কিলোমিটার জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ১৪৮ কিলোমিটারের অবস্থা ভালো। আগের বছরে ভালো অবস্থায় ছিল এক হাজার ৯৭৭ কিলোমিটার। এবার ৮১৩ কিলোমিটারের অবস্থা মোটামুটি। ৩৭৬ কিলোমিটার দুর্বল। ১৮৩ কিলোমিটারের অবস্থা খারাপ। বাকি ২৩৯ কিলোমিটারের অবস্থা খুব খারাপ। আগের বছরে এমন চলাচল অযোগ্য মহাসড়ক ছিল মাত্র ৯৬ কিলোমিটার।

২০১৬ সালের ২ জুলাই চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বয়স এখনও দুই বছর না হলেও দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ হিসেবে পরিচিত এ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট অংশ যান চলাচল অনুপযোগী। জায়গায় জায়গায় পেভমেন্টে (পিচ ঢালাইয়ে) ফাটল এবং পটহোল (গর্ত) দেখা দিয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম-টেকনাফ মহাসড়কের শুরুর দিকে কিছু অংশ খারাপ। যাত্রাবাড়ীতে কিছু অংশের অবস্থা দুর্বল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খারাপ (চট্টগ্রাম যেতে ২৬৯ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত)। কোনো কোনো অংশ যান চলাচল অনুপযোগী। এ ছাড়াও বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্নভাবে খারাপ ও খুব খারাপ। এসব অংশে গাড়ি ধীরগতিতে চলে। মহাসড়কে যানজট সৃষ্টি হয়।

চার লেনের জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কও উদ্বোধন করা হয় ২০১৬ সালের ২ জুলাই। এ মহাসড়কেরও বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট অংশ যান চলাচল অনুপযোগী। জায়গায় জায়গায় পেভমেন্টে ফাটল এবং পট হোল দেখা দিয়েছে। মহাসড়কের ১০৭ থেকে ১১১ কিলোমিটার অংশ দুর্বল ও খারাপ। ১০১ থেকে ১০৫ কিলোমিটার পর্যন্ত চার কিলোমিটারের অবস্থা খারাপ ও খুব খারাপ।

নির্মাণের দুই বছরেই বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত চার লেনের মহাসড়কে ভাঙনের কারণ বলা হয়নি প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক সমকালকে বলেন, মহাসড়কের আয়ুস্কাল ২০ বছর। দুই বছরে ভেঙে যাওয়া অবিশ্বাস্য। নির্মাণ ত্রুটি ছাড়া দুই বছরে রাস্তা ভাঙার কারণ নেই। বাংলাদেশের মতো বৃষ্টিবহুল দেশে বিটুমিনের বদলে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করা উচিত।

তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রকল্প পরিচালক আফতাব হোসাইন খানের অভিমত, দেশের প্রধান এই মহাসড়কের দুরবস্থার জন্য দায়ী মাত্রাতিরিক্ত যান চলাচল ও অতিরিক্ত ওজনবাহী যান চলাচল। তিনি সমকালকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেভাবে অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচল করে তাতে লোহা দিয়ে রাস্তা বানালেও টিকবে না। ট্রাকের ওজন বহনের ক্ষমতা ১৫ টন, মালিক-শ্রমিকদের দাবির মুখে ২২ টন পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চলছে ৫০ টন মালামাল নিয়ে। তারপরও সড়ক টিকবে কী করে।

অতিরিক্ত পণ্য বহন বন্ধে ‘এক্সেল লোড নীতিমালা’ করেছে সরকার। জরিমানা বাড়িয়ে কয়েক গুণ করা হয়েছে। মহাসড়কে রয়েছে ওজন স্কেল। তারপরও কীভাবে চলছে অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন? এ প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, যারা আইন প্রয়োগ করেন এ প্রশ্নের জবাব তারা দিতে পারবেন।

যান চলাচলে বার্ষিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ‘রোড পেভমেন্ট ডিজাইন গাইড-২০০৫’ অনুযায়ী মহাসড়কের আয়ুস্কাল নির্ধারণ করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক ভাঙার জন্য অতিবৃষ্টি ও অতিরিক্ত ওজনবাহী যান চলাচলই দায়ী নয়। নির্মাণেও বড় ধরনের গলদ রয়েছে। সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারের অভিযোগ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহাসড়কে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কিন্তু ঠিকাদার ব্যবহার করেন ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন। নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারের কারণে গরমে তা গলে যায়। এ কারণে সড়কে গর্ত ও ফাটল দেখা দেয়। দুদকের প্রতিবেদনে সওজকে সবচেয়ে অনিয়মগ্রস্ত সরকারি সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসানের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, সড়কের স্থায়িত্ব বাড়াতে হলে নির্মাণের পর আয়ুস্কাল পর্যন্ত মেরামতের দায় ঠিকাদারকে নিতে হবে- এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলে ঠিকাদার ভালো মানের সড়ক বানাতে বাধ্য হবে। সড়ক-মহাসড়ক ভাঙার আরেকটি কারণ সক্ষমতার অতিরিক্ত ভারী যানবাহন। সড়কে সর্বোচ্চ ৪৩ টন পণ্যবাহী যান চলাচলের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু ৮০ টন পর্যন্ত পণ্য বহনের নজির রয়েছে। শামছুল হক বলেন, মহাসড়ক টেকাতে হলে এক্সেল লোড নীতিমালা বাস্তবায়ন করতেই হবে।

সওজের কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের পরিচালক ড. আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, মহাসড়ক ভাঙার কারণ বিকল্প সড়ক না থাকা। পিচ ঢলাইয়ের ৪৮ ঘণ্টা ‘কিউরিং টাইম’ রাখতে হয়। এ সময়ে সড়কে যান চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু বিকল্প সড়ক না থাকায় বাংলাদেশে নির্মাণের পরই রাস্তা খুলে দিতে হয় যান চলাচলের জন্য।

এইচডিএমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জেলা সড়কের। ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার জেলা সড়কের ১০ হাজার ৩৯৩ কিলোমিটার জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৯ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই খারাপ। আগের বছরে ৫৭৪ কিলোমিটার ছিল চলাচল অযোগ্য। ৬৫৮ কিলোমিটারের অবস্থা খারাপ। জেলা সড়কের ৫১ ভাগ ভালো। বাকিটা দুর্বল ও মোটামুটি।

চার হাজার ২৪৬ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের তিন হাজার ৮২১ কিলোমিটার জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ ভাগই ভালো। আগের বছরে ৪২ ভাগ ছিল ভালো। ২৯৪ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই খারাপ। আগের বছরে চলাচল অযোগ্য ছিল ১৭০ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক।

সওজের অধীন ১০টি জোনের মধ্যে রাস্তা সবচেয়ে খারাপ বরিশালে। এ জোনের ৩২০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা খুব খারাপ, যা এ জোনের প্রায় ৩০ শতাংশ রাস্তা। সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম সমকালকে বলেন, ‘গত বর্ষার পর রাস্তার অবস্থা খারাপ ছিল। এখন ভালো আছে। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক মেরামত করা হয়েছে।’ তবে এইচডিএমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরিশালে ২৭ কিলোমিটার মহাসড়কের অবস্থা খুবই খারাপ।

২০১৭-২০১৮ সালের প্রতিবেদন

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment