অমরত্ব! বড্ড বাড়াবাড়ি শোনাচ্ছে? টানা দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারেনি কেউ। গার্দিওলার বার্সেলোনা নয়, ফার্গুসনের ইউনাইটেড নয়, দেল বস্কের রিয়াল মাদ্রিদও নয়। সেখানে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা! এমনই এক অবিশ্ব্বাস্য কান্ড করেছে জিনেদিন জিদান ও তাঁর দলবল। লিভারপুলকে কিয়েভের ‘ঠাই নাই ঠাই নাই’ স্টেডিয়ামে ৩-১ গোলে হারিয়ে দিয়ে অমরত্ব নিশ্চিত করেছে জিদানের দল।
ম্যাচ শুরুর অনেক আগ থেকেই একজনের নাম সবার মুখে, মোহাম্মদ সালাহ। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল কি মাতাচ্ছেন সালাহ? উত্তরটা ২৯ মিনিটেই জানা হয়ে গেল। না! ২৫ মিনিটে পাওয়া এক চোটে মাঠ ছেড়েছেন সালাহ। প্রথম মিসরীয় হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলার রেকর্ড গোলে রূপ নিল না।
সার্জিও রামোসের সঙ্গে বল দখলের এক লড়াইয়ে কাঁধে ছোট পান সালাহ। একটু বিশ্রাম নিয়ে মাথে ফিরলেও দুই মিনিট পরেই হাল ছেড়ে দিতে হয় মিসরীয় ফরোয়ার্ডকে। কান্নাভেজা চোখে সালাহ মাঠ ছাড়ার একটু পরেই জিনেদিন জিদানকেও প্রথম বদলি নামাতে হলো। রাইট উইংয়ে আক্রমণে অংশ নিতে গিয়ে ছোট পেয়েছেন এই রাইটব্যাক। কারভাহালও কান্না নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন, তবে তাঁর কান্নায় ছিল আরেকটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল থেকে ছোট নিয়ে মাঠ ছাড়ার দুঃখ। সে সঙ্গে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার হতাশাও। কারণ প্রাথমিকভাবে অন্তত দেড় মাস মাঠের বাইরে থাকার ভয়ই পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর আগে ফাইনালের শুরুটা প্রত্যাশা মতোই হয়েছে। শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবল। প্রথম ৪ মিনিটেই ৪টি আক্রমণ। লিভারপুলের তিনের বদলে রিয়ালের এক। প্রথম দশ মিনিটে লিভারপুলের দাপটই থাকল। ১০ মিনিট পেরোনোর পর আস্তে আস্তে খেলায় ফিরল রিয়াল। সালাহ-মানেদের জবাবে মডরিচ-বেনজেমারাও আক্রমণ করছিলেন। ১৩ মিনিটে সালাহ-মানের জোড়া শট ঠেকানোর পরের মিনীতে রোনালদোর শট বারের ওপর দিয়ে গেল। এভাবেই চলেছে খেলার প্রথম এক-তৃতীয়াংশ।
সালাহ উঠে যাওয়ার পর দাপট বাড়ে রিয়ালের। মাঠে বল দখলে এগিয়ে যায় তারা, আক্রমণেও। ৪২ মিনিটে করিম বেনজেমা গোলও কর ফেলেছিলেন। কিন্তু রোনালদো অফসাইডে থাকায় সেটা বাতিল হয়। প্রথমার্ধের শেষভাগে নাচো ও বেনজেমা দুটো লক্ষ্যভ্রস্ট শট নেওয়ায় খেলায় সমতা ভাঙেনি।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই এগিয়ে যেত পারত রিয়াল। ৪৭ মিনিটে ইসকোর শট ক্যারিয়াসকে ফাঁকি দিলেও ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে বল।
৫১ মিনিটে ক্যারিয়াসের ভয়ংকর ভুলে পিছিয়ে পড়ে লিভারপুল। ক্রুসের ক্রস ধরতে না পেরে হাল ছেড়ে দেন বেনজেমা। সে বল ধরে ক্যারিয়াস একটু বেশিই অলস ভঙ্গিতে বল দিতে গেলেন ডিফেন্ডারের দিকে। তাঁকে বল ছাড়তে দেখে বেনজেমা পা বাড়িয়ে দিলেন। বল গড়িয়ে গড়িয়ে জালে (১-০)!
৫৫ মিনিটেই ম্যাচে সমতা ফিরে। কর্নার থেকে আসা বলে হেড করেন লভরেন। সেটা এসে পড়ে সাদিও মানের সামনে। হেড থেকে দলকে ম্যাচে ফেরালেন মানে। ৬০ মিনিটে ইসকোর আরেকটি শট দারুণভাবে ঠেকিয়ে দেন ইসকো। পরের মিনিটেই তাঁর বদলি হিসেবে মাঠে নামেন গ্যা সেই অবিশ্বাস্য গোলটি মনে করিয়ে দিয়ে আরেকটি বাই সাইকেল কিক। রিয়াল ২-১ লিভারপুল!
জিদানের অনূভূতি? রোনালদোর সেই গোলের মতোই। মাথায় হাত বুলালেন, তারপর হাত ঝাড়লেন কিছুক্ষণ। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না এমন কিছু আবারও হতে পারে! ধারাভাষ্যকারের ভাষায়, পোয়েট্রি ইন মোশন!
৭০ মিনিটেই সমতায় ফিরতে পারত লিভারপুল। মানের শট একদম মেপে মেপে ঠিক পোস্টেই লাগল। ৭৩ মিনিটে রোনালদো রবার্টসনকে ছিটকে ফেলতে পারলেই এগিয়ে যেতে পারত রিয়াল।
পরের ৭ মিনিটের গল্প লিভারপুলের টানা আক্রমণের। তবু ৮১ মিনিটে আরেকটু হলেই ব্যবধান বাড়াত রিয়াল। বেলের দুর্দান্ত ক্রস থেকে শট নিয়েছিলেন বেনজেমা। এবার ক্যারিয়াসের সেভ বাচাল লিভারপুলকে।
কিন্তু ক্যারিয়াসের আরেকটি ভয়াবহ ভুল লিভারপুলকে হারিয়ে দিল। ২৫ গজ দূর থেকে আচমকা শট নিলেন বেল। সে বল ধরতে গিয়ে কীভাবে যেন জালে পাঠালেন জার্মান গোলরক্ষক (৩-১) !
৮৫ মিনিটে হ্যাটট্রিকও পেয়ে যেতে পারতেন বেল। এবার লভরেনের দারুণ এক ট্যাকল বাঁচাল লিভারপুলকে। ৯৩ মিনিটে মাঠে ছুটে আসা এক দর্শকের জন্য গোলের সুযোগ হাতছাড়া হলো রোনালদোর। এর আগ পর্যন্ত আলো ছড়াতে পারেননি রিয়ালের মূল গোলভরসা।
রোনালদোর নিষ্প্রভ এক দিনেও রিয়ালের ইতিহাস গড়তে কষ্ট হলো না। কারণ, জিদানের এই দল অমরত্ব অর্জনেই নেমেছিল। চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হতেই জন্ম হয়েছে এ দলের।