ভবন নির্মাণে অনিয়মেই বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি

ভবন নির্মাণে অনিয়মেই বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি

রাজধানী ঢাকায় নতুন আতঙ্কের নাম আগুন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের রাজ্জাক টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থেকে চলতি বছরে আগুন নামক আতঙ্কের সূত্রপাত হয়। পরবর্তী সময়ে বনানীর এফআর টাউয়ারসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় আগুন লাগে। এর পিছনে কি কারণ রয়েছে সেটা এখনো পরিষ্কার কেউ বলতে না পারলেও বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা ভাবছেন এবং বলছেন। রাজধানীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশেরই কারণ হিসেবে শর্টসার্কিটকে দায়ী করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবন নির্মাণে অতি মুনাফার আশায় নিম্নমানের তার ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করায় শর্টসার্কিটের দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ। এদিকে কাপ্তান বাজার ও নবাবপুরে গিয়ে প্রতিটি দোকানেই দেখা যায় নকল বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে দেদার। পরপর বেশকিছু জায়গায় আগুন লাগার ফলে এর কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে সরকারের বেশ কয়েকটি টিম। অনুসন্ধানী দল ভবন নির্মাণ কোড মেনে তা নির্মাণ করা হয়েছে কিনা এবং প্রতিটি বিল্ডিংয়ে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা পর্যাপ্ত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখলেও যে কারণে আগুন লাগছে বলে মনে করছেন সে ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। অন্যদিকে ভবন নির্মাণে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও স্থাপত্য প্রকৌশলীর অনুমোদন লাগলেও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারদের অনুমোদনে কোনো বাধ্যবাধকতা আইনে না থাকার কারণেই এ সমস্যা বাড়ছে বলে মনে করেন বুয়েটের ইলেকট্রিক বিশেষজ্ঞরা। দেশের সবচেয়ে বড় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিকিকিনির এলাকা হিসেবে পরিচিত কাপ্তান বাজার ও নবাবপুর রোডেই বৈদ্যুতিক নকল মাল বিক্রি হচ্ছে অবাধে। প্রতিটি দোকানেই পাওয়া যায় স্বনামধন্য কেবল কোম্পানির নকল বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য সরঞ্জাম। এমনকি কোনো কোনো দোকানে কোম্পানির স্টিকার দেয়া থাকলেও সে স্টিকার নকল করে সাঁটানো হয় তার ও অন্যান্য সরঞ্জামে। তারা এমন সূক্ষ্মভাবে কাজটি করেন যে, সাধারণ মানুষ বুঝার ক্ষমতা রাখে না কোনটা আসল কোনটা নকল। যে কারণে তারা সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হন। এসব নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ভোক্তা কারা এমন প্রশ্নে বিক্রেতারা জানান, যেসব কোম্পানি ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকেন, তারাই অতি লাভের আশায় মানের সাথে সমঝোতা করেন। অন্যদিকে নিখুঁতভাবে নকল হওয়ায় মূল ভোক্তাও বুঝতে পারেন না আসল নকলের ফারাক। বিক্রেতারাও জানান, এসব নকল তার অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কারণেই শর্ট সার্কিটের ঝুঁকি বেশি। বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন নম্বর যাই বিক্রি হয় শোরুমে, কারখানা তা বিক্রি করবে না। অরিজিনাল নিলে ঠকার সম্ভাবনা থাকতে পারে দুই নম্বর দিয়ে দিবে। কিন্তু দুই নম্বর নিলে ঠকার সম্ভাবনা থাকে না। বিষয়টি নিয়ে বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে গেলে তারা জানান, মানসম্পন্ন তারে উল্লেখ থাকা মান, নকল তারের ক্ষেত্রে মানা হয় না। ফলে যে অ্যাম্পিয়ার বা লোড নেয়ার ক্ষমতা তারের থাকতে হয় তা না থাকায় অধিক লোডের বৈদ্যুতিক জিনিস ব্যবহারের কারণে শর্টসার্কিটের ঘটনা ঘটে। বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আয়নাল হক আমার সংবাদকে বলেন, নকল বৈদ্যুতিক তারের কারণেই অধিকাংশ সময় আগুনজনিত দুর্ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা প্রয়োজন। এবং যারা ফ্ল্যাট কিনেন তাদের এসব জেনে বুঝে কিনা উচিত। অন্যদিকে বিল্ডিং অনুমোদনের আইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি বিল্ডিং করতে হলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও স্থাপত্য প্রকৌশলীর অনুমোদন লাগলেও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারদের অনুমোদনে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে বৈদ্যুতিক কারণে। সুতরাং বিল্ডিং নির্মাণ আইনে এ বিষয়টিকে যুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নবাবপুরের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবসায়ী জানান, অধিকাংশ সময় বিক্রির পূর্বে আসল নকল বলেই বিক্রি করি। যারা আমাদের কাছ থেকে কিনে তারা বুঝে শুনেই কিনে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন তারা যে কাজটি করছে তাতে কোনো ভুল নেই। সঠিকভাবেই তারা মানুষকে বলেই ব্যবসা করছেন। কোনো প্রতারণা করছেন না। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, নিরাপদ নগরায়নে ভবনে শুধু মানসম্মত বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকা নিশ্চিত করলেই হবে না, যারা ভবন পরিদর্শন করেন, তাদের বৈদ্যুতিক তারের ব্যবহার ও নিরাপত্তার দিকটিতেও গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি এসব অবৈধ নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল ও সরঞ্জাম তৈরির কোম্পানিগুলোকে আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দেন তারা। এ বিষয়টি এখন গুরুত্বের সাথে দেখার সময় এসেছে। এটি যদি এখন গুরুত্বের সাথে দেখা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে দেশ আরও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে মনে করেন তারা।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment