সালাউদ্দিনকে আগেই হত্যার হুমকি দেয় কন্ডাকটর

ময়মনসিংহের ফুলপুর থেকে গাজীপুরের বাঘেরবাজার পর্যন্ত সালাউদ্দিন (৩৫) ও তার স্ত্রী পারুল আক্তারের (৩২) কাছে ৬০০ টাকা ভাড়া দাবি করেছিল সেই আলম এশিয়া পরিবহনের কন্ডাকটর ও হেলপাররা। কিন্তু সালাউদ্দিন নিজেকে চালক পরিচয় দিয়ে লাইসেন্স প্রদর্শন করে কম ভাড়া রাখার অনুরোধ করলে তারা ক্ষেপে যায়।

বেশ কয়েক দফা শারীরিকভাবে তাকে হেনস্তা করার পর সালাউদ্দিনকে লাথি দিয়ে বাস থেকে ফেলে হত্যার হুমকি দেয় কন্ডাকটর। তাকে রক্ষায় ছোট ভাই কাভার্ডভ্যানচালক জালাল মিয়া (৩১)সহ কয়েকজন এগিয়ে গেলেও বেপরোয়া চালক সালাউদ্দিনকে সবার সামনেই পিষে বীরদর্পে চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সালাউদ্দিনের।

গত রোববার সকালে গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘেরবাজার এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এ ঘটনায় দায়ী বাসচালক, কন্ডাকটর ও হেলপারদের ফাঁসি দাবি করেছেন নিহত সালাউদ্দিনের ছোট ভাই জালাল মিয়া (৩১)। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে সোমবার দুপুরে আলাপকালে তিনি এ দাবি করেন।

জালাল মিয়া স্থানীয় আনসার রোড এলাকায় অবস্থিত একটি বেসরকারি কোম্পানির কাভার্ডভ্যানচালক। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বলতে গিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, ‘বাসের ওস্তাদ (চালক) ইচ্ছা কইরাই (ইচ্ছে করেই) আমার ভাইয়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালায় দেয়।

কতবার চিক্কার (চিৎকার) পাইরা কইছি ব্রেক কর ব্রেক কর ভাই গাড়ির তলে পরতাছে (গাড়ির নিচে পড়ছে)। ওস্তাদ (ড্রাইভার) শুনে নাই। সে ইচ্ছাকৃতভাবেই আমার বড় ভাইকে খুন করছে’ চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন নিহত সালাউদ্দিনের এ ছোট ভাই।

জালাল মিয়া জানান, ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার সূত্রপাত ময়মনসিংহ নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ মোড় এলাকা থেকেই। বাসের কন্ডাকটর ও হেলপারদের হাতে বাসের ভেতরেই নির্যাতনের মুখে পড়ে সালাউদ্দিন তাকে দুই থেকে তিনবার ফোন করেন। ফলে দ্রুতই বাঘের বাজারে ভাই ও ভাবীকে উদ্ধারে ছুটে যান।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘মাওনার আগে মাস্টারবাড়ি এলাকা থেইক্যা (থেকে) ভাই যখন শেষবার আমারে ফোন দিয়া কয় (দিয়ে বলে) ‘ওরা রানিংয়ে গেইট থেইক্যা লাত্থি দিয়া আমারে ফালাইয়া দিবো কইছে (চলন্ত অবস্থায় লাত্থি দিয়া আমাকে ফেলে দিবে বলছে) তুই তাড়াতাড়ি আয়, আমগরে রক্ষা কর (দ্রুত এসে আমাদের উদ্ধার কর)।

আমরা ৩ থেকে ৪ জন বাঘেরবাজারে বাসের সামনে গিয়া সিঙ্গেল দিছি (আমরা ৩ থেকে ৪ জন বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি)। ওরা দুই জন যাত্রী রানিংয়ে নামাইছে। আমার ভাইরে ঠিকই ওরা লাত্থি দিয়া ফালাই দেয়। (দু’জন যাত্রীকে চলন্ত অবস্থায় নামিয়ে আমার ভাইকে লাত্থি দিয়ে ফেলে দেয়) ভাবী তহনও নামতে পারে নাই। ভাই গাড়ির সামনে গিয়া দাঁড়াইলে তার ওপর দিয়াই গাড়ি চালায় দিয়া মাইরা ফেলে।’

বাষ্পরুদ্ধ হাহাকার নিয়ে জালাল মিয়া বলেন, ‘এক ড্রাইভার হইয়া ওরা আরেক ড্রাইভাররে মাইরা ফেললো (এক চালক হয়ে আরেক চালককে মেরে ফেললো)। ওরা খুনি। ওগোর বিচার হইতেই হইবো। ওগোর বিচার না অইলে আমার ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাইবো না।’

ধোবাউড়া থেকে সেই ঘাতক চালক আটক
ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলা থেকে পলাতক ঘাতক চালক রোকন উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছে গাজীপুর জেলা পুলিশ। গতকাল সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ আবিদ হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

পুলিশ জানায়, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে গ্রেপ্তার এড়াতে সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় আত্মগোপন করে মূলত ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল চালক রোকন। তবে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি পুলিশের দায়িত্বশীল কেউ।

স্পেশাল সিটিং সার্ভিসের নামে প্রতারণা
আলম এশিয়া পরিবহন দীর্ঘদিন যাবত ‘স্পেশাল সিটিং সার্ভিসের’ নাম করে স্থানীয় যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। এ পরিবহনের চালকরা বেপরোয়া গতিতে যেমনি ছোটেন তেমনি অনেক চালকেরই ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্সও নেই।

এমন অভিযোগ করে স্থানীয় যাত্রীরা বলেন, এ বাসের ভেতরের পরিবেশও অপরিচ্ছন্ন। বাতি ও ছাদ পাখা নষ্ট প্রায় সব বাসেই। আদতে যাত্রী উঠিয়ে নামিয়ে ঢাকা পর্যন্ত ৫ থেকে ৬ ঘণ্টায় চলা এ পরিবহনটিকে অনেকেই ‘লোকাল সার্ভিস’ হিসেবেও টিপ্পনি কাটেন। কিন্তু এরপরও তারা বাড়তি ভাড়া হাতিয়ে নিয়ে যাত্রীদের পকেট কাটছেন।

স্থানীয় যাত্রীরা আরও অভিযোগ করেন, ওভারটেকিং প্রবণতা আর বেপরোয়া গতির কারণেই প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চলছে এ পরিবহনের বাস। কিন্তু প্রভাবশালীরা এ পরিবহনের সঙ্গে জড়িত থাকায় সব সময়ই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকেছে পরিবহনটি। এ পরিবহনের চেয়ারম্যান ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের জ্যেষ্ঠ ছেলে অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিম।

আপনি আরও পড়তে পারেন