কারও দৃষ্টি পড়েনি এই বৃদ্ধার দিকে

প্রতিবেশীদের তৈরি করে দেয়া একটি ঝুপরি (বসতি) ঘরের মধ্যে পলিথিনের বিছানায় বসবাস করেন প্রতিবন্ধি ময়না। মশারী ও কোনও প্রকার আলো ছাড়া ঘরে সঙ্গী বলতে মশা, মাছি, পোকামাকড় আর ঠাণ্ডা বাতাস। তার ডান হাত ও ডান পা একেবারে অচল ও অকার্যকর। এ জন্য অসহায় ও শীতার্ত ময়নার প্রাকৃতিক কাজকর্ম বিছানাতেই সারতে হয়।

নওগাঁ সদর উপজেলার মসরপুর দক্ষিনপাড়া গ্রামের মৃত মিরি ফকিরের স্ত্রী মাহমুদা বেওয়া (ময়না)। বয়স প্রায় ৭০ ছুইছুই। রাস্তায় পথচারীদের শব্দ পেলেই ‘দে,দে,দে,দে… হামাক অ্যানা ভাত দে’ বলে চিৎকার করে সচল বাম হাতটি বাড়িয়ে দেয় একমুঠো খাবারের জন্য।

সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রকার সহায়তা থেকে বঞ্চিত ময়নার এ যেনো আজন্ম আকুতি। কখনও কারও দৃষ্টি পড়েনি এই বৃদ্ধার দিকে।

জানা গেছে, নাম পরিচয়হীন, বোবা ও কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন এক কিশোরীকে ভিক্ষুক মিরি ফকির ভিক্ষা করতে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়ে নিয়ে আসে নিজের ভাঙা ঘরে। বিয়ের পরে মিরি ফকির মাহমুদার নাম রাখেন ময়না।

প্রতিবেশী নজরুল ইসলামের একখণ্ড জমিতে তালপাতার তৈরি ছোট্ট বসতিঘরে একসাথে ভিক্ষা করে খেয়ে না খেয়ে কোনও মতে চলছিল ময়না এবং মিরি ফকিরের সংসার। ভিক্ষুক স্বামী মিরি মারা গিয়েছে প্রায় ২৫ বছর আগে। এরপর থেকে একাই কখনও নওগাঁর বালুডাঙ্গা আবার কখনও নওহাটা বাসস্ট্যান্ডে ভিক্ষা করে রাতের বেলা কখনও খোলা আকাশের নিচে আবার কখনও যাত্রী ছাউনিতে শুয়ে খেয়ে না খেয়ে চলছিল ময়নার জীবন। তার এই কষ্টের কথা ভেবে প্রতিবেশীরা সকলে মিলে পুনরায় তাকে নিয়ে আসে তার স্বামীর ঠিকানায়।

নিজের চিকিৎসা ও দু’বেলা দু’মুঠো খাবার কিংবা মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য সরকারি কোনও সাহায্য জোটেনি কোনও দিনই।

জমির মালিক প্রতিবেশি নজরুল ইসলাম বলেন, বয়স্ক এই মহিলার বিষয়টি ভাবতেও কষ্ট লাগে। এই ঠাণ্ডার মধ্যে আলো-বাতি ছাড়া অচল হাত পা নিয়ে একটি মানুষ আর কতদিন বাঁচতে পারে। সরকারি কোনও জায়গায় অথবা বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে গেলে সে হয়তো বাঁচতো। তার এই অবর্ণনীয় কষ্ট দেখে আমাদের খুব খারাপ লাগে।

অসহায় মাহমুদাকে দেখাশোনার কাজে স্বেচ্ছায় নিয়োজিত প্রতিবেশী সাহারা বানু বলেন, হামি মানসের বাড়িত কাম (কাজ) করে খাই। আশপাশের লোকেরা প্রতিদিন মাহমুদাক খাবার দেয় হামি সেডা (সেই খাবার) লিয়া যাইয়া ওক খিলাইয়া বিচনা, কাপড় বদলাইয়া দিয়া আসি।

প্রতিবেশী ডা: মোহাব্বত আলী বলেন, বছর দুয়েক আগে মাহমুদা স্ট্রোক করেছিল। আমি আমার ক্লিনিকে নিয়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন আমরা প্রতিবেশিরা সবাই মিলে সাহারা বানুর মাধ্যমে খাবার দিয়ে মহিলাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। মহিলার বিষয়টি নিয়ে উপজেলা সমাজ সেবা অফিস, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যের কাছে গত ২ বছর ধরে ঘুরেছি শুধু একটা কম্বল দেয়া ছাড়া কিছুই করতে পারেনি তারা। অগত্যা নিজে যখন যতটুকু সম্ভব করার তাই করছি।

প্রতিবেশী রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, সরকারিভাবে এমন হত-দরিদ্র আর অসহায় মানুষদের জন্য ঘর, টিন, সোলার, স্যানিটারি ল্যাট্রিন, টিউবওয়েল, চাল দেয়া হয়। অথচ হতভাগী মাহমুদা এর সব কিছু থেকে বঞ্চিত। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

হাপানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আফসার আলী বলেন, আমি মহিলাটিকে চিনি। ২০/২৫ বছর আগে তার ভিক্ষুক স্বামী মারা গেছে। এক সময় তারা দু’জনেই ভিক্ষা করে চলতো। এখনতো সে বিছানা থেকেই উঠতে পারে না। কিছুদিন আগে তাকে একটা কম্বল দিয়েছি তবে তার কোনও অভিভাবক নেই, থাকলে আমার সাথে যোগাযোগ করলে হয়তো তার নামে একটা কার্ড করে দিতাম।

নওগাঁ সদর উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা সাইদুর রহমান বলেন, আমি এখানে অল্প কিছুদিন আগে এসেছি। ময়নার প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবা এর কোনও প্রকার ভাতা ভোগী না হওয়ার বিষয়টি সত্যি অমানবিক। তার এনআইডি কার্ড এবং ছবিসহ আমার সাথে যোগাযোগ করলে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার একটা ব্যবস্থা করে দেবো।

আপনি আরও পড়তে পারেন