করোনা সচেতনতায় সবচেয়ে অবহেলিত গ্রামাঞ্চল

বিদেশফেরত প্রবাসীদের অধিকাংশই অবস্থান করছেন মফস্বলের বাড়িতে। ফলে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি শহরের চেয়ে কোনো অংশে কম নেই গ্রামে। যদিও সচেতনতায় সবচেয়ে অবহেলিত রয়েছে গ্রামাঞ্চল।

শিক্ষার অভাব ও কুসংস্কারের কারণে গ্রামের মানুষ করোনাভাইরাস বিষয়ে কম সচেতন। সচেতনতা সৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধেও। এ অবস্থায় এখনই গ্রামে এ মারণ ভাইরাসের বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করাটা জরুরি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডা. জাফরুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, বেশির ভাগ প্রবাসী তো গ্রামেরই। তাই সেখানে ঝুঁকিও স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। আমার মতে, কোয়ারেন্টিনে থাকা বিদেশফেরতদের জেল-জরিমানা না করে বেশি করে সচেতন করা প্রয়োজন। তাদের বলতে হবে, যেন বাড়ির উঠানের বাইরে না যান। এটা তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য ও দেশের জন্য। আর গ্রামের বাজারগুলোতে হাটের দিনে অনেক ভিড় হয়। এক্ষেত্রে বাজারের প্রবেশমুখগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে থার্মোমিটারের মাধ্যমে আগতদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা যেতে পারে। সব মিলিয়ে প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সচেতন জনগোষ্ঠীর উচিত এ বিষয়ে না জানা ব্যক্তিদের সচেতন করে তোলা।

করোনাভাইরাস বিষয়ে সতর্কতার অংশ হিসেবে বন্ধ করা হয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সীমিত করা হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমও। তাই ছুটি পেয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ছেড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ। যদিও নিরাপদ গন্তব্যের খোঁজে বাড়ি ফিরেও স্বস্তি মিলছে না তাদের। শহর থেকে বাড়ি ফেরাদের অভিযোগ, করোনাভাইরাস আতঙ্কে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর রাস্তা যেখানে ফাঁকা, সেখানে গ্রামাঞ্চলের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা বলছেন, গ্রামাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা বিষয়ে তেমন কোনো সতর্কতাই নেই। হাট-বাজারসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে বেশ জনসমাগম হচ্ছে।

করোনা আতঙ্কের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে চাঁদপুরের গ্রামের বাড়িতে যান রিয়াজ হোসাইন। গ্রামাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সচেতনতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ঢাকায় মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে যে ধরনের সচেতনতা দেখেছি, গ্রামে এর ছিটেফোঁটাও নেই। এখানকার জীবনযাত্রায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ব্যতীত করোনার কোনো প্রভাব নেই বললেই চলে। মানুষজন স্বাভাবিকভাবেই হাটবাজার কিংবা ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে। অনেককে সচেতন করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি।

দেশের প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা নোয়াখালী। জানা যায়, গত দুই-তিন মাসে কয়েক হাজার প্রবাসী বিদেশ থেকে ফিরে এলাকায় অবস্থান করছেন। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন প্রবাসীকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হলেও সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফেরাদের বেশির ভাগই এ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে নোয়াখালীর বাসিন্দা ও পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যাকশন নেটওয়ার্কের (প্রাণ) প্রধান নির্বাহী নুরুল আলম মাসুদ বলেন, এখানকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা বিষয়ে কোনো ধরনের সচেতনতা নেই বললেই চলে। অথচ নোয়াখালীতে গত কয়েক মাসে হাজার হাজার প্রবাসী বাড়িতে এসেছেন। গতকাল শুনলাম শুধু একটি উপজেলায়ই আট-নয়শ প্রবাসী এসেছেন, এর মধ্যে মাত্র ২০-২৫ জন কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। তাদেরও ঠিকমতো তদারকি হচ্ছে না। বাকি প্রবাসীরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যদি প্রবাসীদের একজনও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সেটি খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। কেননা এলাকার হাট-বাজার ও চায়ের দোকানগুলো খুব জমজমাট। এছাড়া ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বেশ জনসমাগম হচ্ছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার হার কম হওয়ায় এমনিতেই সচেতনতা কম। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যরাও কোনো ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন না।

উদ্যোগ নিয়েও সচেতনতা বাড়ানো যাচ্ছে না বলে দাবি নোয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. মো. মোমিনুর রহমানের। তিনি বলেন, গ্রামের মানুষের সচেতনতার মাত্রা খুবই খারাপ। মাইকিং ও লিফলেট বিতরণসহ নানা উদ্যোগ নিয়েও এখানকার মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। এমনকি কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীরা নির্দেশনা মানছেন না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেকের জরিমানাও করা হয়েছে। ওয়াজ-মাহফিলসহ জনসমাগম হয় এমন অনুষ্ঠানগুলোতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

পাশের জেলা লক্ষ্মীপুরে খোঁজ নিয়েও একই চিত্র পাওয়া যায়। যদিও প্রবাসী সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় জেলাগুলোর একটি লক্ষ্মীপুর। জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনগুলোতে হাট বসছে নিয়মিতই, যেখানে সমবেত হচ্ছেন হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতা। জেলার সদর উপজেলার মান্দারী বাজারে হাট বসে প্রতি শুক্র ও সোমবার। গত শুক্রবার বাজারটিতে কয়েক হাজার মানুষের জনসমাগম হয়। বাজারে আসা মানুষদের করোনা বিষয়ে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ করেন স্থানীয় বিকেবি ক্লাবের সদস্যরা। এ বিষয়ে বিকেবি ক্লাবের সভাপতি ইসমাইল খান সুজন বলেন, সপ্তাহে দুদিন এ হাট বসে। অন্যান্য সপ্তাহের মতো আজকের বাজারেও অনেক ভিড় লক্ষ করা গেছে। আমরা ক্লাবের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরণ করে বাজারে আগতদের সচেতন করার চেষ্টা করেছি। করোনা নিয়ে সচেতনতা কম থাকলেও করোনার অজুহাতে এখানকার দ্রব্যমূল্য অনেক বাড়ানো হয়েছে। গত হাটে যে সবজি প্রতি কেজি ১০-১৫ টাকা ছিল, আজকের বাজারে সেটি বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

এদিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অসচেতনতার ফলে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর থেকে বাড়ি ফিরেও করোনা আতঙ্কের মধ্যেই দিনাতিপাত করছেন অনেকেই। করোনাভাইরাস বিষয়ে সতর্কতার অংশ হিসেবে শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি আবাসিক হল ও হোস্টেল বন্ধ করে দিয়েছে দেশের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ। ছুটি ঘোষণায় শহর ছেড়েনেছ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীও। গত বৃহস্পতিবার জরুরি সভা করে আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নির্দেশনা অনুযায়ী গতকাল সন্ধ্যার মধ্যেই হল ছেড়েছেন শিক্ষার্থীরা। বন্ধ ঘোষণার পর বৃহস্পতিবারই চট্টগ্রামের বাড়িতে ফেরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সাজ্জাদুল কবির। সেখানে গিয়ে করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতনতার অভাবের কথা তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ শিক্ষার্থী লেখেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা ছাড়া বিকল্প নেই। ঢাকায় লোকজন সতর্ক হলেও জেলা পর্যায়ে অবস্থা ভয়াবহ। এতটা অসচেতন! করোনার বিষয়ে সতর্ক করার কথা বললে রীতিমতো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হচ্ছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন