যে কারণে আটকে আছে খালেদার লন্ডনযাত্রা

দুর্নীতির মামলায় দোষী সাজা পেয়ে দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় কারাবন্দি থাকার পর সরকারের নির্বাহী আদেশে চলতি বছর ২৫ মার্চ ছয়মাসের জন্য শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তার মুক্তির শর্ত ছিল, এ সময়ে তাকে নিজের বাসায় থাকতে হবে এবং তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। কিন্তু এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার উন্নতা চিকিৎসায় লন্ডন যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন বিএনপির নেতারা। কিন্তু শর্তের কারণে আপাতদৃষ্টিতে তার লন্ডন যাত্রা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে বিএনপির আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।

খালেদা লন্ডনযাত্রা প্রসঙ্গে কৌশলগত কারণে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কোনো পক্ষই মুখ খুলতে রাজি না। তবে সরকার যদি অনুমতি দেয় তাহলেও করোনা মহামারির মধ্যে খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন তার পরিবার ও দলীয় নেতাদের অনেকে। পরিস্থিতির উন্নতির পরই কেবল বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি ভাবতে চান তারা। এমন আভাসই দিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।

বেগম জিয়ার পারিবারিক ও দলের সূত্র বলছেন, সরকারের সঙ্গে আলোচানা বা দরকষাকষি করে আপাতত লন্ডন যেতে রাজি নয় বিএনপি নেত্রী। কার্যত জামিন পাওয়ার ন্যায় সঙ্গত অধিকার তার আছে। তাই পরিস্থিতি ভালো হলে উচ্চ আদালতে আবারও জামিন চাইবেন তিনি। সেখানে জামিন পেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার চিন্তাভাবনা করবেন খালেদা জিয়া।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়া নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তার বিদেশে যাওয়া প্রয়োজন। তবে বিদেশে যেতে পারবেন না- এমন শর্তেই সরকার তাকে জামিন দিয়েছে। অন্যদিকে দেশের হাসপাতালগুলোরও বেহাল অবস্থা। এর মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারি। ক্ষমতাসীন দলের নেতার চিকিৎসায় বিদেশ যাচ্ছে। বিএনপি নেত্রীর বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন। খালেদা জিয়ার ওপর বিদেশে না যাওয়ার জন্য শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এটা বৈষম্যমূলক।

খালেদা জিয়াকে লন্ডন যাওয়ার অনুমতি দেওয়া প্রসঙ্গে সরকার কী ভাবছে? জানতে চাইলে বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেগম জিয়াকে যে দুই শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তাতে তার দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকারের নির্বাহী আদেশে ছয় মাসের জন্য সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মানবিক কারণ ও বয়স বিবেচনায় ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেওয়া হলেও শর্তাবলীতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বেগম জিয়া তার ঢাকার বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন ও বিদেশে যেতে পারবেন না। আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ শেষ হবে। বিএনপি নেত্রীর আবেদন ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে তার মুক্তির মেয়াদ বাড়বে কিনা।

বিএনপি নেতারা মনে করেন, সরকার শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে জামিন দিয়েছে। এখন চিকিৎসা নিতে বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে আর কোনো ‘শর্ত’ সহজে মেনে নেবেন না তিনি। নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, দেশ ও দলের সার্বিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই লন্ডনে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান ওই নেতারা।

দলীয় সূত্র জানায়, বিদেশে না যাওয়ার শর্ত দিয়ে জামিন নিলেও এখন তা পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানানো হচ্ছে পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ চলছে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে নানা শর্ত দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে লন্ডনে থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি না দেওয়া, সভা-সমাবেশে যোগদান থেকে বিরত থাকা, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করা, বিদেশিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এসব শর্ত মেনে খালেদা জিয়া লন্ডন যেতে রাজি হচ্ছেন না। শর্ত ছাড়াই যেতে চান তিনি।

বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা জানান, অতীতে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতা জামিন নিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিতে বিদেশে গেছেন। রাজনৈতিক মামলায় জামিন নিয়ে অনেকে বক্তব্য-বিবৃতি, বিদেশ সফর এবং নেতাকর্মীদের সঙ্গে সভা-সমাবেশও করেছেন। ওই নেতার দাবি, খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে এত শর্ত দেওয়া অগণতান্ত্রিক। অবশ্য করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে সরকারের সঙ্গে এসব নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা চালানোর কথা জানান ওই নেতা।

খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। এখন উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হোক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে নিশ্চয় তার পরিবারের সদস্যরা আবেদন করবেন। হাতে এখনও সময় আছে।

খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে বিএনপি নেত্রী বড় বোন সেলিনা ইসলামবলেন, লন্ডনে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারের কাছে আবেদন করার বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা করাতে জামিনের জন্য আইনি লড়াই চালানো হয়েছিল। তাতে সফল না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ‘সমঝোতা’র মাধ্যমে ও শর্তসাপেক্ষেই জামিন নেওয়া হয়েছিল। করোনা মহামারির মধ্যে সরকারের সেসব শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্পও ছিল না তখন। বর্তমানে খালেদা জিয়া বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখন বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতনিসহ ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়মিত টেলিফোনে কথা বলছেন। দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে সাক্ষাৎ করছেন।

বিএনপির নীতিনির্ধারক একটি সূত্র জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে চিকিৎসা নিতে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রিন সিগন্যালের যে খবর বেরিয়েছে, তা সঠিক নয়। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রচার চালানো হতে পারে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এতে বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ ছাড়া সরকার অনুমতি দিলেও দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে লন্ডনের হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে গিয়ে তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জানান, এখন করোনা মহামারির মধ্যে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। আগে পরিস্থিতির উন্নতি হোক। এখন পর্যন্ত তার লন্ডনে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি। নেত্রীও এ বিষয়ে কিছু বলেননি।

৭৫ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়অ মামলায় সাজা হওয়ার পর থেকেই প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে আসছিলেন। কিন্তু আইনি লড়াই ও রাজপথের আন্দোলন ব্যর্থ হলে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে নির্বাহী আদেশে জামিন দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাসের জন্য সাজা স্থগিত করে গত ২৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি মামলা বিচারের পর্যায়ে আছে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজা ভোগ করছেন খালেদা জিয়া। দুই মামলায় তার ১৭ বছরের সাজা হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন