এসএসসি’২১: অটোপাস না পরীক্ষা?

এসএসসি’২১: অটোপাস না পরীক্ষা?

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে গোটা বিশ্বকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এই প্রতিকূল স্রোতের মুখোমুখি বাংলাদেশও। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মতো বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষা খাত। প্রায় ১০ মাস ধরে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কিছু ক্ষেত্রে অনলাইনে কার্যক্রম চলমান। তবে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় অটো প্রমোশন বা অটোপাস ঘোষণা করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষাও। এবার করোনার ঢেউয়ের মুখে ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা।

দেশে করোনা পরিস্থিতি বলা যায় আগের মতোই। প্রতিদিন মৃত্যু ও শনাক্তের শঙ্কা উঠা-নামা করছে। অন্যদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে এসএসসি’২১ ব্যাচের পরীক্ষার সময়। গত বছর এসএসসি ২০২০ ব্যাচের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ফেব্রুয়ারিতে। এ বছর ফেব্রুয়ারি আসন্ন। কিন্তু এর মধ্যে পরীক্ষা নেওয়ার বা দেওয়ার মতো কোনো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে করোনার ভয় রয়েছে। ফলে তড়িঘড়ি পরীক্ষা দিতে অনাগ্রহী শিক্ষার্থীরা।

কয়েকটি মতামত জরিপে দেখা গেছে, ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রস্তুতিতে পরীক্ষা দিতে চান না। ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত পরিচালিত মতামত জরিপে প্রশ্ন ছিল, ‘করোনার মধ্যে আগামী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নিয়ে নানা দাবি করছে শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে আপনি কোন দাবিটি সমর্থন করেন?’। প্রশ্নের বিপরীতে তিনটি অপশন দেওয়া হয়; ১. অটোপাস ঘোষণা। ২. পরীক্ষা পেছানো। ৩. সিলেবাস কমানো।

২৫ ডিসেম্বর দুপুর ২টা পর্যন্ত মতামত জরিপে মোট ৫৩ হাজার ৩৯৬ জন ভোট দেন। এর মধ্যে অটোপাসের পক্ষে মতামত দিয়েছেন ৫০ হাজার ৮১৩ জন বা ৯৫. ১৬ শতাংশ, পরীক্ষা পেছানোর পক্ষে ৮৩২ জন বা ১.৫৬ শতাংশ ও সিলেবাস কমানোর পক্ষে ১ হাজার ৬৭৮ জন বা ৩.১৪ শতাংশ।

২০২১ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এসব শিক্ষার্থী বছরের প্রায় পুরোটাই ক্লাস-পরীক্ষা থেকে দূরে রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু প্রায় ৯ মাস ক্লাস-পরীক্ষা থেকে দূরে থাকার পর ব্যাপকভাবে মানসিক চাপে ২০ লাখ কিশোর-কিশোরী।

এমন পরিস্থিতিতে গত ২৯ ডিসেম্বর লাইভ ব্রিফিংয়ে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, সিলেবাস ছোট করে পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে। দুই দিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে না। ছেলে-মেয়েদের ঝুঁকিতে ফেলা হবে না। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন ঘোষণার পরও শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ দূর হচ্ছে না।

কিশোর বয়সের এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপে রয়েছে। সামাজিকমাধ্যমে তাদের থেকে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মেসেজ (ক্ষুদে বার্তা) পাওয়া যায়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বলছে, তারা ব্যাপক মানসিক চাপে রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের এই মানসিক চাপের প্রথম কারণ, এক. প্রত্যেকের মনে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয় কাজ করছে। সামাজিক দূরত্ব না মেনে স্কুল কলেজ খুলে দিলে বা পরীক্ষা নিলে করোনা সংক্রমণের ভয় রয়েছে সবার মধ্যে। দুই. পরীক্ষা হবে কিনা এটা তারা নিশ্চিত হতে পারছে না। তিন. পরীক্ষা হলে কখন হবে? এবং চার. পরীক্ষা হলে প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হবে কিনা?

সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ থেকে এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর এখনও দেওয়া হয়নি। এর মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া বা সর্ট (ছোট) সিলেবাসের প্রশ্ন আসায় আরও বেশি মানসিক চাপে পড়ছে ২০ লাখ কিশোর-কিশোরী। এ ধরনের মানসিক চাপের কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

এক রিপোর্টে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অধ্যাপক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে দুই ধরনের ইস্যু আছে। একদিকে পরীক্ষা সময় মতো না হলে সেশনজট হবে। অন্যদিকে অল্প সময় দিয়ে পরীক্ষা নিলে শিক্ষার্থীদের ওপর বিরাট বোঝা বা মানসিক চাপ দেওয়া হবে। মানসিক চাপে পড়লে এর কিছু ফলাফল হতে পারে যেমন, পারফর্মেন্স খারাপ হতে পারে, মোটিভেশন কমে যাবে, ড্রপআউট হতে পারে। অনেকে ভয়ে এবার পরীক্ষা নাও দিতে পারে। এসব মানসিক চাপের ফলে অনেকে ড্রাগ নেওয়াও শুরু করে। এ জন্য সব বিষয় ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া।’

কিন্তু প্রয়োজনীয় সময় দিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন, এক. করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এর মধ্যে কীভাবে পরীক্ষা হবে সেটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। টিকা আসলেও তা কী পরিমাণ আসবে এবং ২০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য কতটা টিকা বরাদ্দ হবে তা নিশ্চিত নয়। দুই. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে তা সবার আগে নিশ্চিত হতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের নিশ্চিত করতে হবে। তিন. এটি নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে কতটা সময় পাবেন শিক্ষার্থীরা, তা ঘোষণা করতে হবে। যেহেতু এসএসসি পরীক্ষা সময় দোরগোড়ায় সেহেতু সময় ঘোষণা না করে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ মানসিক চাপে পড়বে। চার. যদি পর্যাপ্ত সময় দিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা হয় তাহলে পরবর্তী পরীক্ষা ও সেশনের জটিলতা হতে পারে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এসএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ফেব্রুয়ারি মাসে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই ফেব্রুয়ারি মাসে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। এমনকি এক বা দুই মাস সময় দিয়েও পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে না। এটি করা হলে শিক্ষর্থীদের ওপর জোর করে পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হবে। এতে প্রায় সবারই পরীক্ষায় খারাপ করার শঙ্কা দেখা দেবে। পরীক্ষা নিতে হলে কমপক্ষে চার-পাঁচ মাস সময় দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এপ্রিল মাসে রোজা। রোজার মধ্যে ক্লাস-পরীক্ষা যদি না হয় তাহলে সময় আরও বাড়াতে হবে। পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় দিয়ে পরীক্ষা নিলেও ফলাফল প্রকাশ হতে আরও সময় লাগবে। তাহলে এইচএসসিতে তারা যে ব্যাচে ভর্তি হবে সেই ব্যাচও পিছিয়ে যাবে। অর্থাৎ শিক্ষাখাত এক দীর্ঘ জটিলতার মধ্যে পড়ে যাবে।

বিকল্প হিসেবে সরকার সিলেবাস ছোট করার চিন্তা করতে পারে। সম্ভবত এই বিষয়টি বলতে চেয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ খুব একটা লাঘব হবে বলে মনে হয় না। কারণ, দীর্ঘ সময় পড়ার টেবিলে না থাকায় মানসিকভাবে শিক্ষার্থীরা একেবারেই এ ধরণের পরীক্ষার জন্য অপ্রস্তুত। যার প্রতিফলন দেখা গেছে সময় নিউজের মতামত জরিপে।

আবার সিলেবাস ছোট করে স্বল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে আসলে শিক্ষার্থীদের আদৌ কোনো উপকার হবে কিনা তা ভাবা দরকার। যদি পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসের বিষয়গুলো পড়ানোই না হয় তাহলে ছোট সিলেবাস আর অটোপাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য কোথায়? এখানে একটি পার্থক্য হয়তো হবে যে, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট পেয়েছে। কিন্তু এভাবে পরীক্ষা নিয়ে সনদ দেওয়াটা নৈতিক দিক দিয়ে কতটা শক্তিশালী হবে?

অন্যদিকে অটোপাস ঘোষণা করা হলে সুবিধা-অসুবিধা কী তা দেখা দরকার। পরিস্থিতির কারণে অটোপাসের নজির রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরপর একবার এমন অটোপাস দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতিও দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এসএসসি’২১ ব্যাচের অটোপাস দিলে, সময় দিয়ে পরীক্ষা নিতে গেলে যেসব জটিলতা সৃষ্টি হবে সেগুলো এড়ানো যাবে। এছাড়া ২০ লাখ শিক্ষার্থীকে মানসিক চাপ মুক্ত করা যাবে।

এসএসসি পাস দিয়ে কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, কবি বা সাহিত্যিক হয়ে যায় না। শিক্ষাজীবনে এসএসসি সনদ পেয়ে এইচএসসি ভর্তি হতে হয়। এইচএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর স্নাতক। সুতরাং এসএসসি অটোপাস দিলে তার এইচএসসি ও উচ্চ শিক্ষায় এর কোনো নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা নেই। কারণ, অটোপাস দিলেও শিক্ষাজীবনে এই সনদের মূল্যায়ণ স্বাভাবিক সনদের মতোই। কোনো কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে অটোপাসের সনদ বাধা নয়। সুতরাং আসন্ন এসএসসি’২১ ব্যাচকে অটোপাস দেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা সামাজিকমাধ্যমে কয়েকটি দাবিও তুলে ধরেছে। তাদের দাবিগুলো মোটাদাগে, ১. করোনার ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত স্কুল খোলা যাবে না। ২. করোনা চলাকালীন কোনো ধরনের পরীক্ষা ( স্কুল বার্ষিক পরীক্ষা, টেস্ট পরীক্ষা ও এসএসসি পরীক্ষা) নেওয়া যাবে না। ৩. স্কুল কার্যক্রম ৮ মাস বন্ধ ছিল, তাই এই ৮ মাসের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এসএসসি পরীক্ষা ১০ মাস পেছাতে হবে। ৪. পরীক্ষা ৮ মাস পেছানো হলে তার জন্য সেশনজট সৃষ্টি হবে, এর ফলে জীবন থেকে পরবর্তী ১ বছর ঝরে যাবে। তাই এই সেশনজটের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৫. যদি উপরোক্ত দাবি না মেনে জোরপূর্বক করোনা চলাকালীন সময়ে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং পরীক্ষা চলাকালীন যদি কেউ করোনা পজিটিভ হয়, তাহলে সেই ছাত্রের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ৬. যদি এসএসসি পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের ওপর ভিত্তি করে অটোপ্রমোশন দিতে হবে।

এসব দাবির পক্ষে সামাজিকমাধ্যমে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষাদের অন্তত ১০টি গ্রুপ খোলা হয়েছে। যেখানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। ওইসব শিক্ষার্থীই উপরের দাবিগুলো তুলে ধরেছে। সুতরাং বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর এই দাবিকে সরকার বিবেচনায় নেবে আশা করি।

আপনি আরও পড়তে পারেন