ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কৌশলগত মিত্র হওয়ায় পাকিস্তানের প্রতি আর আগ্রহ নেই যুক্তরাষ্ট্রের; কেবল আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সামলানোর জন্যই পাকিস্তানকে গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
বৃহস্পতিবার রাজধানী ইসলামাবাদে নিজ বাসভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রকে এভাবেই কটাক্ষ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
সংবাদ সম্মেলনে ইমরান খান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত সহযোগী হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের আর আগের গুরুত্ব নেই।’
‘ইদানিং অবশ্য ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে; আর সেই আগ্রহের কারণও আমরা ভালোভাবেই বুঝি। তাদের ২০ বছরের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ফলে বর্তমানে আফগানিস্তানে যে ছারখার পরিস্থিতি, জঞ্জাল সৃষ্টি হয়েছে, তা সামাল দেওয়ার জন্যই এখন পাকিস্তানকে মনে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের।’
আফগানিস্তানে সংঘাতের অবসান ও বিদ্রোহী তালেবানগোষ্ঠীর সঙ্গে দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে সম্প্রতি ইসলামাবাদকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে ওয়াশিংটন। এই আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায় সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা করেছিল মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক। সে সময় এই গোষ্ঠীর প্রধান ঘাঁটি ছিল তালেবান শাসিত আফগানিস্তান।
টুইন টাওয়ারে হামলার জেরে ওই বছর আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে মার্কিন ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো। অভিযানে পতন হয় তালেবান সরকারের।
অভিযানের প্রায় ২০ বছর পর গত এপ্রিলে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন, ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব মার্কিন ও ন্যাটো সেনাসদস্যকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। পরে এই সময়সীমা আরও এগিয়ে ৩১ আগস্ট করা হয়।
বাইডেনের ঘোষণার পর থেকেই নতুন উদ্যমে অভিযান শুরু করেছে তালেবান এবং অত্যন্ত দ্রুতগতিতে দ্রুতগতিতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিচ্ছে। গ্রামীণ এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এখন বড় বড় শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো দখল করছে তালেবান। এতে করে দেশটি মারাত্মক এক নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার তালেবানের হাতে দশম প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে গজনি শহরের পতন হয়েছে।
রাজধানী কাবুল থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরে গজনির অবস্থান। কৌশলগত কারণে গজনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শহরটি কাবুল-কান্দাহার মহাসড়কসংলগ্ন অবস্থিত। কাবুলের সঙ্গে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ এই সড়কপথ দিয়েই হয়ে থাকে।
গজনি ছাড়াও তালেবানগোষ্ঠী ইতোমধ্যে বাগলান প্রদেশের রাজধানী পুল-ই-খুমরি, ফারাহ’র রাজধানী ফারাহ, নিমরোজের রাজধানী জারাঞ্জ, তাখারের তালোকান, কুন্দুজের রাজধানী কুন্দুজ, সার-ই-পল প্রদেশের রাজধানী সার-ই-পাল, সামানগানের রাজধানী আইবাক, জাওজানের শেবেরগান, বাদাখশানের ফয়জাবাদ দখল করে নিয়েছে।
তালেবানপন্থিদের আগ্রাসী এই অভিযানের ফলে দেশটির প্রধান শহরগুলোর ভাগ্য নিয়ে ভীষণ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন, সরকারী বাহিনী ও তালেবান- উভয়পক্ষ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও পশ্চিমা কয়েকটি দেশের সরকারের অভিযোগ, পাকিস্তানের পরোক্ষ মদদের ফলেই তালেবানগোষ্ঠীর শক্তিমত্তা এতখানি বেড়েছে এবং তালেবানগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক অভিযানেও পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে পাকিস্তান।
এই অভিযোগ আরও দৃঢ় হয়েছে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বিষয়ক একটি প্রস্তাব দেশটির সরকার খারিজ করে দেওয়ার পর থেকে।
তবে পাকিস্তান বরাবরই দাবি করে আসছে, তালেবানগোষ্ঠীর প্রতি কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের নেই। বৃহস্পতিবারের সাক্ষাৎকারেও ইমরান খান সে কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন।
তবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, সরকারি সমর্থন লাভের আশায় তালেবান নেতারা তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস আগে তালেবান প্রতিনিধিদের একটি দল আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আমি তাদের আহ্বান জানিয়েছিলাম, সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো যায় কিনা সে বিষয়টি যেন তারা বিবেচনা করেন।’
‘কিন্তু তারা আমাকে বলেছেন, যতদিন আশরাফ গনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন কোনো সমঝোতায় যেতে তারা প্রস্তুত নন।’
‘আর এখন আফগানিস্তানে যে পরিস্থিতি, তাতে দেশটির সরকার ও তালেবানগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো প্রকার সমঝোতা হওয়া কার্যত প্রায় অসম্ভব।’