স্তন ক্যানসার সারাতে পারে চা, তিন বাঙালির গবেষণা

অস্ত্রোপচার করাতে হবে না? অস্ত্রোপচারের পরেও দীর্ঘ দিন ধরে চালিয়ে যেতে হবে না কেমোথেরাপি? সহ্য করতে হবে না কেমোথেরাপির ওষুধের জোরালো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ধাক্কা? এবার কি তবে ওষুধেই পুরোপুরি সারানো যাবে স্তনের সবচেয়ে ভয়ংকর রোগ ‘ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার’?

তেমনই আশা জাগিয়েছে তিন ভারতীয় বাঙালির আবিষ্কার। আমেরিকার কানসাসে ভেটারেন অ্যাফেয়ার্স মেডিক্যাল সেন্টারের দুই অধ্যাপক সুশান্ত ও স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাদের গবেষক ছাত্র অম্লান দাস এমন একটি রাসায়নিক মিশ্রণ তৈরি করেছেন, যা দিয়ে ওষুধ বানানো হলে স্তনের সবচেয়ে ভয়ংকর ক্যানসারও সেরে যেতে পারে। সেই মিশ্রণের প্রধান যৌগটি থাকে গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি— সব ধরনের চায়েই। গ্রিন টি-তে থাকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে। তাদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা গবেষণা পত্রিকা ‘ফার্মাকোলজি : রিসার্চ অ্যান্ড পারস্পেক্টিভ্স’-এ।

গবেষকরা যে রাসায়নিক মিশ্রণটি তৈরি করেছেন, তা ইঁদুরের উপর পরীক্ষায় পুরোপুরি সফল হয়েছে। গবেষকরা প্রথম পর্যায়ের (ফেজ-ওয়ান) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর চেষ্টা চালাচ্ছেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য অবশ্য মানবশরীরে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে।

হার্ট অ্যাটাকের পরেই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নারীর মৃত্যু হয় যে অসুখে, তা হল স্তন ক্যানসার। নারীদের মোটামুটি যে ৯ ধরনের ক্যানসারে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়, তার মধ্যে একেবারে শীর্ষে রয়েছে স্তন ক্যানসার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, গত বছর অতিমারির সময় বিশ্বে ২৩ লক্ষ নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যাও তার কাছাকাছি। বিশ্বে অন্যান্য ক্যানসারে নারীদের আক্রান্ত হওয়ার হার যেখানে ১.৬ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে, সেখানে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার গড়ে ৩০ শতাংশ। সাড়ে আট গুণেরও বেশি!

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, সবক’টি মহাদেশেই নারীদের মৃত্যুর সবচেয়ে গুরুতর কারণ যে সব রোগ, তার তালিকায় প্রথম তিনটি প্রাণঘাতী অসুখের একটি স্তন ক্যানসার। ক্যানসারের টার্গেটেড বা প্রিসিশন থেরাপি ও কেমোথেরাপির যথেষ্ট উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ভারতে প্রতি ১০ মিনিটে একজন নারীর মৃত্যু হয় স্তন ক্যানসারে। আর প্রতি ৪ মিনিটে ১ জন নারী স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা করান। ২০১৮ সালে ভারতে বিভিন্ন ক্যানসারে আক্রান্ত নারীর ২৭ শতাংশই ছিলেন স্তন ক্যানসারের রোগী। বাকি ৭/৮ রকমের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩৫.২ শতাংশ নারী। এর মধ্যে রয়েছেন সব বয়সের নারীই। কলকাতায় যে ১০ রকমের ক্যানসারে নারীদের আক্রান্ত হতে দেখা যায়, তার ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ স্তন ক্যানসারের রোগী।

 

স্তন ক্যাসারের ধরন

স্তন ক্যানসার মূলত ৪ ধরনের হয়। এক. এস্ট্রোজেন রিসেপ্টর পজিটিভ (ইআর প্লাস) স্তন ক্যানসার। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের দেহে ক্যানসার কোষ বাড়তে সাহায্য করে এস্ট্রোজেন হরমোন (প্রোটিন)। বিভিন্ন হরমোন থেরাপির মাধ্যমে এই ক্যানসার নিরাময় সম্ভব।

দুই. প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর পজিটিভ (পিআর প্লাস) স্তন ক্যানসার। এ ক্ষেত্রে নারীদের দেহে ক্যানসার কোষ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে প্রোজেস্টেরন হরমোন (প্রোটিন)। হরমোন থেরাপি করে এই ক্যানসারও সারানো যায়।

তিন. হিউম্যান এপিডার্মাল গ্রোথ ফ্যাক্টর রিসেপ্টর (এইচইআর টু প্লাস) স্তন ক্যানসার। এই ক্যানসারের ক্ষেত্রে নারীদের দেহে এইচইআর টু প্লাস প্রোটিন সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর অ্যান্টিবডির মাধ্যমে এই ক্যানসারও সারানো যায়।

চার. ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসার। প্রথম তিন ধরনের স্তন ক্যানসারই হয় তিনটি প্রোটিনের জন্য। এই সব ধরনের ক্যানসার সারিয়ে তোলা সম্ভব চিকিৎসায়। কিন্তু ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের রোগীর দেহে ওই তিনটি প্রোটিন থাকে না। তাই এর চিকিৎসা এক রকম অসম্ভবই। এই ক্যানসারই সবচেয়ে ভয়াবহ। রোগীকে বাঁচাতে অস্ত্রোপচার করে স্তন বাদ দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। তার পরেও রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে দীর্ঘ দিন ধরে কেমোথেরাপি চালিয়ে যেতে হয়। যার নানা রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়।

আগের গবেষণায় কী কী জানা গিয়েছিল?

অন্যতম গবেষক, কানসাসের ভেটারেন অ্যাফেয়ার্স মেডিক্যাল সেন্টারের ক্যানসার রিসার্চ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্তা অধ্যাপক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্রায় ১০ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে আগেই দেখা গিয়েছিল মানবদেহে ‘সিসিএন-৫’ নামে একটি বিশেষ জিন রয়েছে যা টিউমার সাপ্রেসর হিসাবে কাজ করে। ক্যানসার কোষ বৃদ্ধি রুখে দেয়। এ-ও দেখা গিয়েছিল, বাইরে থেকে দেহে সিসিএন-৫ জিনটি ঢোকানো হলে ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের কোষ আর বৃদ্ধি হচ্ছে না। সেই কোষের মধ্যে ক্যানসারের ধর্ম (অঙ্কোজেনিক প্রপার্টিজ) কমে যাচ্ছে। কমছে ক্যানসার স্টেম সেলের পরিমাণও। দেখা যায়, ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের রোগীর দেহে এই সিসিএন-৫ জিন আদৌ সক্রিয় থাকে না।

গ্রিন টি খেতে অভ্যস্তদের কেন কম হয় স্তন ক্যানসার?

এপিডিমিওলজির বিভিন্ন গবেষণায় এর আগে দেখা গিয়েছে, পৃথিবীর যে সব দেশের মানুষ বা যে সব জনগোষ্ঠী কয়েকশ বছর ধরে মূলত গ্রিন টি নিয়মিত খেতে অভ্যস্ত, তারা স্তন ক্যানসারে ততটা আক্রান্ত হন না। এর জন্য গ্রিন টি-তে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা একটি যৌগের বড় ভূমিকা থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিল বিভিন্ন গবেষণা। যৌগটির নাম ‘ইজিসিজি’ বা ‘এপিগ্যালোক্যাটেচিন’। এই যৌগটি থাকে সব রকমের চায়েই। তবে গ্রিন টি-তে যে পরিমাণে থাকে, অন্য রকমের চায়ে থাকে তার চেয়ে অনেক কম। আগের গবেষণায় দেখা যায়, স্তন ক্যানসার রুখতে এই ইজিসিজি যৌগটির তেমন চটজলদি কোনো ভূমিকা নেই। দীর্ঘ দিন ধরে যেসব দেশের মানুষ বা জনগোষ্ঠী গ্রিন টি খেতে অভ্যস্ত, শুধু তাদের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। এর কারণ একটাই— গ্রিন টি-তে থাকা এই যৌগটিকে বেশি ক্ষণ মানবশরীর ধরে রাখতে পারে না।

এই গবেষণার কী কী লক্ষ্য ছিল?

মূল গবেষক অম্লান দাস জানিয়েছেন, তাদের মূলত দুটি লক্ষ্য ছিল। এক. গ্রিন টি-তে খুব বেশি পরিমাণে থাকা এই ইজিসিজি যৌগটিকে কোনো ভাবে মানবশরীরে অনেক বেশি সময় ধরে রাখা সম্ভব কি না তা দেখা।

দুই. ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত কোষের বৃদ্ধি রুখতে পারে মানবশরীরে থাকা যে জিন, সেই সিসিএন-৫-এর সক্রিয়তা এই ইজিসিজি যৌগটি বাড়াতে পারে কি না, সেটা পরীক্ষা করে দেখা।

কী পেলেন গবেষণায়?

গবেষণায় একটি রাসায়নিক মিশ্রণ বানানো হয়। ‘চিটোসান’ নামে একটি পলি স্যাকারাইড দিয়ে বানানো খাঁচায় ইজিসিজি-র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাকে (ন্যানো-পার্টিক্যাল) পুরে ফেলা হয়। তার পর তার সঙ্গে ফোলিক অ্যাসিডকে জুড়ে দেওয়া হয়। ফোলিক অ্যাসিড ব্যবহারের কারণ আগেই গবেষকদের জানা ছিল, সুস্থ, স্বাভাবিক মানবকোষের ভিতরে যে গতিতে যে হারে নানা ধরনের বিপাকক্রিয়া হয়, ক্যানসারে আক্রান্ত কোষে সেই গতি বা হার অনেক বেশি।

জানা ছিল, সুস্থ, স্বাভাবিক মানবকোষের চেয়ে ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলোর অনেক বেশি পরিমাণে দরকার হয় ফোলিক অ্যাসিড আর ভিটামিন বি-১২। তাদের বিপাকক্রিয়ার গতি ও হার বাড়ানোর জন্য। যা ক্যানসার কোষ বৃদ্ধির সহায়ক হয়। তাই ফলিক অ্যাসিড এই মিশ্রণটিকে ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসারের কোষের মধ্যে ঢুকতে সাহায্য করে। আর তাতেই কেল্লা ফতে। খাঁচার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ইজিসিজি-র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো ক্যানসার কোষকে মেরে ফেলে।

সুশান্ত ও তাঁর স্ত্রী অন্যতম গবেষক স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এই পরীক্ষায় চারটি ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।

এক. দুই দল ইঁদুরের ক্ষেত্রেই ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলোতে ক্যানসারের ধর্ম কমে গিয়েছে। সমান পরিমাণে।

দুই. দুই দল ইঁদুরের ক্ষেত্রেই ক্যানসার স্টেম সেলের পরিমাণ কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। যা প্রমাণ করছে, গবেষকদের বানানো মিশ্রণে বাইরে ফোলিক অ্যাসিডের খাঁচা থাকলেও তা ক্যানসার কোষ বিপাকক্রিয়ার হার বাড়াতে সাহায্য করতে পারছে না। বরং খাঁচার ভিতরে থাকা ইজিসিজি-র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি থামিয়ে দিচ্ছে।

তিন. মানবশরীরের যে সিসিএন-৫ জিন সক্রিয় হলে বা যার সক্রিয়তা বাড়লে ক্যানসার কোষ বৃদ্ধি আর হতে পারে না, সেই জিন ৩/৪ গুণ বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে দু’দল ইঁদুরের দেহেই ইজিসিজি যৌগটি ঢোকানোর ফলে।

চার. শুধু ইজিসিজি যৌগ খাওয়ালে ক্যানসারে আক্রান্ত ইঁদুর যত তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে, তার তিন গুণ তাড়াতাড়ি সেরে উঠছে ফোলিক অ্যাসিডের খাঁচায় পোরা ইজিসিজি-র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাকে দিয়ে বানানো মিশ্রণটি খাওয়ালে। যার অর্থ, ফোলিক অ্যাসিডের খাঁচা দিয়ে বানানো মিশ্রণে থাকা ইজিসিজি অণু ইঁদুরের দেহ দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পারছে। সেই ইজিসিজি অণুগুলো রেচনতন্ত্রের মাধ্যমে ইঁদুরের দেহ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে না।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন