চট্টগ্রামে কাপাসগোলা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ

চট্টগ্রামে কাপাসগোলা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ।

রক্ষকই হয়ে উঠেছেন ভক্ষক, পিতা-মাতার পর যেখানে শিক্ষকের জায়গা সেখানে শিক্ষক হয়ে উঠেছে মাংসাশী পশু সমতুল্য এমনই ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম নগরীর
কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে উঠেছে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের গুরুতর অভিযোগ। যেখানে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে তারই বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেওয়ার কথা, সেখানে তিনি নিজেই সন্তানতুল্য ছাত্রীদের বিভিন্ন প্রলোভনে যৌন হয়রানি করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। ছাত্রী, শিক্ষক, স্কুল কর্তৃপক্ষ, কর্মচারী সকলের কাছে বিষয়টি জানা, কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস পায় না কেউই।

প্রধান শিক্ষক মোঃ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এ নতুন নয়। ৬ বছর আগেও ২০১৩ সালে দ্বাদশ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করে হয়েছিলেন বরখাস্ত। ৫ বছর পর একই বিদ্যালয়ে ফের প্রধান শিক্ষক ফিরে আসার সুবাদে এবং চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়ার সহপাঠী পরিচয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ছাত্রীরা তো বটেই, এমনকি মহিলা শিক্ষকরা সঙ্গী ছাড়া প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকতে ভয় পান। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এই চেহারার আড়ালে বারবারই ধামাচাপা পড়ে যায় যৌন হয়রানির সবগুলো ঘটনা। সম্প্রতি বিদ্যালয়ের প্রাতঃ বিভাগের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে আড়ালে অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছে।

জিইসির কোচিংয়ে ধর্ষণের চেষ্টা! ভুক্তভোগী ছাত্রীর সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথোপকথন শুরু করেন প্রধান শিক্ষক মোঃ আলাউদ্দিন। শিক্ষক আলাউদ্দিন ওই ছাত্রীকে স্কুলে গেলে বারবার তার কক্ষে যাওয়ার প্রস্তাব দিতেন। ছাত্রী প্রতিবারই একা যেতে ভয় পাচ্ছে বলে জানালেও প্রতিউত্তরে প্রধান শিক্ষক নিজেকে ‘দয়ালু মানুষ’ এবং ‘ভয় না পাওয়া’র আশ্বাস দেন। একা যেতে ভয় পাওয়ায় ওই ছাত্রী এক আয়াকে বিষয়টি জানায়। এভাবেই তখন এক কান-দুই কান করে বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক বিষয়টি জেনে যায়। পরবর্তীতে জিইসি মোড়ের এক কোচিং ক্লাসে ওই ছাত্রীকে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী ছাত্রী সেখানে একা গেলে সেখানে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হলে কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে ওই ছাত্রী। এছাড়াও নানা সেক্সুয়াল বার্তাও ছাত্রীকে মেসেঞ্জারে পাঠাতেন প্রধান শিক্ষক। বিষয়টি নিয়ে ছাত্রীর অভিভাবক স্কুলের এক জুনিয়র শিক্ষককে জানালে একে একে স্কুলের সকল শিক্ষক, এলাকাবাসীর মোবাইলে মেসেঞ্জারে কথোপকথনের স্ক্রিনশট চলে যায়। তারপর থেকেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি ধমকি দিতে শুরু করেন প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘দুই শিফটে স্কুল। বাচ্চারা তো ভয় পায়। ওরা (শিক্ষার্থীরা) অভিযোগ করার মত ওইরকম সাহস এখনো পায়নি। এই ছোট ছোট বাচ্চারা এটার গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারে না। এ ঘটনায় ছাত্রীর পরিবার থেকে স্কুলে লিখিত অভিযোগ না গেলেও ইতিমধ্যে পুরো এলাকায় জানাজানি হয়ে গেছে। সবাই এ ঘটনা জানেন। মহিলা শিক্ষকই সহযোগী! জানা গেছে, এ ঘটনায় প্রথম দিকে ওই ছাত্রীর অভিভাবক আইনের আশ্রয় নিতে চাইলে স্কুলের আরেক সহকারী শিক্ষক জাহানারা বেগম তড়িঘড়ি করে নিজে থেকে দায়িত্ব নেন বিষয়টি ফয়সালা করার। অভিভাবকের মোবাইল থেকে সকল প্রমাণাদি সংগ্রহ করে ঘটনা ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য অন্য শিক্ষকদের তিনি জানান, ও তেমন কিছু না। এগুলো নিয়ে এত চিৎকার-চেঁচামেচি হাউকাউ করার কিছু নেই।’ ছাত্রীর পরিবারকে এই বিষয় নিয়ে কোনো রকমের আওয়াজ না করার পরামর্শও দেন ওই মহিলা শিক্ষক। জাহানারা বেগম আরও সাবধান করে ছাত্রীর পরিবারকে জানান, বড় ধরনের বিপদে পড়তে না চাইলে এই বিষয়ে আর যেন কথা না বাড়ায় এবং মেয়ে মানুষ কলঙ্ক হয়ে যাবে। ছাত্রীর পরিবারকে ওই মহিলা শিক্ষক আরও বলেন, দরকারটা কী? মেয়ে স্কুলে পড়তে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। টিসিও দিয়ে দিতে পারে। এসব ঝামেলায় জড়ানোর কী দরকার?’ জানা যায়, ২০১৩ সালে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর পুনরায় ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল একই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন আলাউদ্দিন। আর প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেউই সরাসরি নাম প্রকাশ করে মুখ খুলতে চায় না। স্কুলের মহিলা শিক্ষকরাও তার দুষ্ট নজর থেকে রেহাই পান না। মান-সম্মান আর চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি নন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক জানান, জাহানারা বেগম নামের এক সহকারী শিক্ষক আর শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক মমতাজ হলেন প্রধান শিক্ষকের প্রধান সহযোগী। প্রধান শিক্ষকের সকল অপকর্মকে ধামাচাপা দেয়ার দায়িত্ব তারা নিয়েছেন। কেউ কেউ ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কথা বলতে নারাজ আবার কেউ কেউ বাড়তি ঝামেলা না জড়িয়ে গা বাঁচিয়ে চলতে চাইছেন বলেও চুপ করে আছেন দেখেও না দেখার মতো। হুমকি ও চাপের মুখে ছাত্রীর পরিবার ভয়ে জানা গেছে, কেবল একপাক্ষিক চাপ প্রয়োগ করেই ক্ষান্ত হননি প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন। নির্যাতিত ছাত্রীর পরিবার যে বাসায় ভাড়া থাকেন সেই বাড়িওয়ালার সাথে প্রধান শিক্ষকের ভালো সম্পর্ক। বিষয়টি নিয়ে আর জল ঘোলা না করে সেইজন্যই ছাত্রীর পরিবারকে বাড়িওয়ালার মাধ্যমেও হুমকি ধমকি দিতে শুরু করেন। এসব নানামুখী চাপে এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ভুক্তভোগী ছাত্রীর পরিবারটি। এছাড়া আরও নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়। আর এতেই চুপসে যায় ওই ছাত্রীর পরিবার। ভুক্তভোগী ছাত্রীর পরিবারের এক সদস্য বলেন, প্রধান শিক্ষক আর বাড়িওয়ালার ভয়ে চুপসে যাই আমরা। নিরাপত্তার জন্য যেখানে বাচ্চাকে দিয়েছি সেখানেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তাহলে আমরা কার কাছে বিচার নিয়ে যাব? স্কুলের এক শিক্ষককেপ্রথম দিকে জানানোর পর নানামুখী হয়রানি আরও বেড়ে গেছে। শিক্ষকরাও অসহায় জানা গেছে, প্রধান শিক্ষকের এই অপকর্ম নিয়ে অন্য শিক্ষকেরা কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। প্রধান শিক্ষকের কাউকে ভয় আবার কাউকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে রেখেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, তিনি যেখানে ছিলেন, সেখানেই এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও প্রতিবেদন হয়েছে। এরপরও তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। আমরা তো আসলে উনার ওপর কথা বলতে পারি না। উনি সর্বেসর্বা স্কুলে উনার নানান অপকর্ম নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে তিনি গুটিকয়েক শিক্ষকদের বলেছেন এটা ২০১৩ সাল নয় এটা ২০১৮। তাছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়াকে নিজের বন্ধু বলে দাবি করেন। শিক্ষাবোর্ডের অনেক কর্মকর্তা, সচিব তার হাতের মুঠোয়। আর উনাদের নাম ভাঙিয়েই সব অপকর্ম করার প্রচেষ্টায় থাকে। তিনি আরও বলেন, বাচ্চাটা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্কুলের পরিবেশ খুবই জঘন্য। যদি একবার দেখে যেতেন এটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনে হবে না। যেন একটা পরিত্যক্ত ডাস্টবিন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহকারী শিক্ষক বলেন, আমাদের স্কুলে একজন মহিলা প্রধান শিক্ষক প্রয়োজন। বাচ্চারা এখন কার কাছে যাবে সমস্যা নিয়ে? যদি আজ মহিলা শিক্ষক হতো তাহলে একটা সমাধান হতো। আর এখানে প্রধান শিক্ষকই নোংরা মানসিকতার। বাচ্চারা কোথায় আর যাবে? ওই শিক্ষক বলেন, ‘২০১৩ সালে যৌন হয়রানির এমন ঘটনায় বরখাস্ত ছিলেন প্রায় দুই বছর। এরপর আবার ২০১৮ সালে কাপাসগোলা স্কুলে আসার পর থেকেই থেমে নেই তার পুরানো কুঅভ্যাস। ঘটে যাচ্ছে একের পর এক ঘটনা। এর মধ্যে শুধু সামনে এসেছে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর এই ঘটনা। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি প্রসঙ্গে এক শিক্ষক বলেন, না পারছি বলতে, না পারছি সহ্য করতে। যৌন হয়রানিবিরোধী কমিটি নামেই আছে, এর
কোনো কাজ নেই। আমরা অতটুকুই বলতে পারি যে আমরা সেফটি ফিল করি না। ওনার রুমে যেতে হলে সাথে করে আরেকজন শিক্ষককে নিয়ে যাই। প্রধান শিক্ষক টোপ ফেলেন মেসেঞ্জারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগী ছাত্রীর এক প্রতিবেশী বলেন, ব্যাপারটা সত্যি। আমরা বিষয়টি দেখি। মেসেঞ্জার চ্যাটিংয়ে হেডমাস্টার অনেক বাজে বাজে লেখা পাঠায়। বাজে বাজে কথা বলে। তার মাঝে বেশি বাজে কথাগুলোকে আমরা ডিলিট করে ফেলি। মেয়েটা ঘটনার বিবরণ জানায়। পালিয়ে এসেছে বলেই তার ক্ষতি হয়নি। কিন্তু তারপরও তো মেয়েটা নিরাপদে থাকতে পারছে না। প্রতিদিনই ভয়ে ভয়ে
কাটাতে হচ্ছে দিন। এটা কি আসলেই কাম্য? এই শিক্ষককে এর আগেও ২০১৩ সালে হাতেনাতে আটক করা হয় অসামাজিক কার্যকলাপরত অবস্থায়। তারপর সাময়িক বরখাস্ত করাও হয়। এরপরও একই পদে আবারও পুনর্বহাল কী করে হয়, তাই ভেবে পাচ্ছি না। তিনি বলেন, মহিউদ্দিন অনুসারীরা যদি এই বিষয়ে প্রতিবাদ করে, তাহলে চসিক মামলা করে দেবে বলেও হুমকি ধমকি দেয়। তাই মামলা-হামলার ভয়ে কেউই এগিয়ে আসতে চায় না। এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, নানান অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু যার কোন প্রতিকার নেই। এদিকে এ ঘটনায় চকবাজার এলাকায় তোলপাড় পড়ে গেলে ভুক্তভোগী ছাত্রীর পক্ষ হয়ে গত ৮ ডিসেম্বর একজন অভিভাবক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে একটি অভিযোগ জমা দেন। অভিযোগের এতদিন পেরিয়ে গেলেও এখনো পাওয়া যায়নি এর কোন প্রতিকার।

 

 

আপনি আরও পড়তে পারেন